রেলওয়েকে এগিয়ে নিতে ১৫টি চ্যালেঞ্জ বা বাগড়া চিহ্নিত করা হয়েছে। ২০৪৫ সালের মধ্যে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে সবকটি চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হবে বলে মনে করছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হলো জনবল। মন্ত্রণালয় বলছে, অর্ধেক জনবল দিয়ে বর্তমানে সারা দেশে রেল পরিচালনা করা হচ্ছে। অবকাঠামোর চেয়ে গত ১৫ বছরে নজর দেওয়া হয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নে। এ কারণেই দিন দিন সংকট বেড়েছে।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, রেলওয়ের সামনে বর্তমানে ১৫টি চ্যালেঞ্জের মধ্যে করিডরগুলোতে সিঙ্গেল লাইন একটি বড় সমস্যা। এর বাইরে গেজ ইউনিফিকেশন, সেতু ক্যাপাসিটির সীমাবদ্ধতা, যাত্রী ও মালপত্র পরিবহনের সক্ষমতা সমস্যা দীর্ঘদিনেও সমাধান হয়নি। এ ছাড়া যথাযথ রেলওয়ে নেটওয়ার্কের অনুপস্থিতি, রেলপথ সম্প্রসারণ, আন্তঃদেশীয় রেল যোগাযোগে রেলওয়ে আশানুরূপ সফলতা অর্জন করতে পারেনি। কোচ ও লোকোমোটিভের স্বল্পতা, পুরোনো সিগন্যালিং সিস্টেম, রক্ষণাবেক্ষণ প্রতিবন্ধকতা, রাজস্ব আয় বৃদ্ধি না হওয়ায় দিন দিন প্রতিষ্ঠানের লোকসানের মাত্রা বাড়ছে।
রেলের অন্যতম চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে, উন্নয়ন প্রকল্প এবং রক্ষণাবেক্ষণ খাতে অর্থায়ন স্বল্পতা, আধুনিক টিকিটিং সিস্টেম, জনবল স্বল্পতাসহ অপ্রতুল প্রশিক্ষণ। রেলওয়ে সূত্র বলছে, বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের ৩০৯টি লোকোমোটিভ রয়েছে। এর মধ্যে ১৭৪টি মিটারগেজ এবং ১৩৫টি ব্রডগেজ। মিটারগেজ লোকোমোটিভের মধ্যে ৬৯ শতাংশ লোকোমোটিভ এরই মধ্যে অর্থনৈতিক মেয়াদ ২০ বছর অতিক্রম করেছে। ৮৭টি অর্থাৎ ৪৪ শতাংশ লোকোমোটিভ ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে পরিষেবা দিয়ে আসছে, যা প্রতিস্থাপন প্রয়োজন। তা ছাড়া ওভারেজ লোকোমোটিভগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ কঠিন এবং ব্যয়বহুল, যন্ত্রাংশও দুষ্প্রাপ্য। ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রক্ষণাবেক্ষণ করেও আর্থিকভাবে লাভজনক হওয়া যাচ্ছে না।
অন্যদিকে ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৪৩টি নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে। একই সঙ্গে ৪৪
ট্রেনের রুটের দৈর্ঘ্য বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এ সময়ে সংস্থাটির মোট লোকোমোটিভের সংখ্যা বেড়েছে মাত্র ২২টি। ৩০৯টি লোকোমোটিভের মাধ্যমে প্রতিদিন ৩৬৭টি ট্রেন পরিচালনা করতে হয়। অর্থাৎ ইঞ্জিনের চেয়ে ট্রেনের সংখ্যা বেশি। কম ইঞ্জিন দিয়ে বেশি ট্রেন পরিচালনা করতে হচ্ছে।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, গড়ে প্রায় ৬০ শতাংশ লোকোমোটিভ, ৪৭ শতাংশ যাত্রীবাহী কোচ ও ৬৭ শতাংশ ওয়াগনের অর্থনৈতিক জীবনকাল শেষ হয়ে গেছে। ৩ হাজার ১১১টি লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে অনুমোদন নেই ১ হাজার ২২৫টির। ফলে প্রায়ই ঘটছে রেল দুর্ঘটনা।
জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম কালবেলাকে বলেন, সব সমস্যা চিহ্নিত হয়েছে। ধাপে ধাপে সবকিছু কাটিয়ে ওঠার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। ৬টি ধাপে ২০৪৫ সাল পর্যন্ত এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে।
সংকটের কথা স্বীকার করে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. কামরুল আহসান বলেন, লাইন নির্মাণের সঙ্গে সংগতি রেখে রোলিং স্টক সরবরাহ ও জনবল নিয়োগের ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারেনি রেলওয়ে। তা ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে উন্নয়ন প্রকল্পে যত মনোযোগ দেওয়া হয়েছে, সেরকমভাবে চলমান অবকাঠামো উন্নয়ন সম্ভব হয়নি। বাজেট সংকটের কারণে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
মন্ত্রণালয়ের নথি থেকে জানা গেছে, সারা দেশে রেলের ৩৩৭টি সিগন্যালিং সিস্টেম রয়েছে। এর মধ্যে কম্পিউটার বেজড সিগন্যালিং ১৩৪টি। রিলে ইন্টারলকিং ৬টি, মেকানিক্যাল ইন্টারলকিং ৮২টি, নন ইন্টারলক কালার লাইট ১১৫টি। ১৯৯৪ সালে কম্পিউটার টিকিটিং সিস্টেম চালু হলেও আজ পর্যন্ত ৫০৭টি স্টেশনে এই সেবা চালু হয়নি। ১১০টি আন্তঃনগর ট্রেনের মধ্যে ১০০ স্টেশনে কম্পিউটারের মাধ্যমে টিকিট ইস্যু করা হয়।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, রেলে মঞ্জুরি করা জনবল ৪৭ হাজার ৬৩৭ জন। কর্মকর্তারা জানান, জনবল সংকটে রেলওয়ের সেবা সঠিকভাবে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে ২৩ হাজার ২৩৪ শূন্য জনবলের মধ্যে প্রথম শ্রেণির শূন্য পদ ৪৬৬টি, দ্বিতীয় শ্রেণির ২ হাজার ১০২টি, তৃতীয় শ্রেণির ৯ হাজার ৪৭৬টি এবং চতুর্থ শ্রেণির শূন্য পদ ১১ হাজার ১৯০টি।
তবে জনবল নিয়োগের কার্যক্রম চলমান রয়েছে জানিয়ে রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. কামরুল আহসান বলেছেন, ‘এরই মধ্যে কয়েকটি পদে নিয়োগ পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। পর্যায়ক্রমে শূন্যপদগুলো পূরণ করা হবে।’ তিনি জানান, রেলওয়ের মোট ৬১ হাজার ৮২১ একর ভূ-সম্পত্তির মধ্যে অবৈধ দখলে ২ হাজার ৪০১ একর রেলভূমি। এই ভূমি উদ্ধারে নিয়মিত উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত রয়েছে। রেলওয়ের আয় বাড়াতে অব্যবহৃত ভূমি ইজারা দেওয়াসহ রেলওয়ের চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে উঠতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে বলেও জানান মহাপরিচালক।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, বর্তমানে রেলওয়ের চলমান প্রকল্প ২৮টি। এর মধ্যে বিনিয়োগ প্রকল্প ২৫টি ও কারিগরি সহায়তা প্রকল্প ৩টি। চলমান প্রকল্পগুলোর জন্য বরাদ্দ রয়েছে ১৪ হাজার ৬৫ কোটি ২৬৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে বরাদ্দ হয়েছে ১২ হাজার ৫৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা।
রেলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, রেলের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে ২০৪৫ সালের মধ্যে ভোলা ছাড়া দেশের সব জেলায় ট্রেনে যাতায়াত করা সম্ভব হবে। তবে ওই সময়ের মধ্যে যদি ব্রিজ বা সাগরের তলদেশ দিয়ে টানেল করা সম্ভব হয়, তা হলে ভোলা জেলাকেও ট্রেন নেটওয়ার্কের আওতায় আনা যাবে। বর্তমানে দেশের ৪৯টি জেলা রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতাভুক্ত। কয়েক বছরের মধ্যে নড়াইল, মেহেরপুর, বরিশাল, বান্দরবান জেলা রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আসবে। আর মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে মাগুরা, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর ও মানিকগঞ্জ এই ৬টি জেলা রেলওয়ের নেটওয়ার্কের আওতায় আসবে। বাকি অন্য জেলাগুলো রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আসবে ২০৪৫ সালের মধ্যে।
অন্যদিকে রেলমন্ত্রী বলেছেন, মহাপরিকল্পনা সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হলে দেশজুড়ে ট্রেনে যাত্রীসেবা যেমন বাড়বে, তেমনি পণ্য পরিবহনের সুযোগ পাবেন ব্যবসায়ীরা। মহাপরিকল্পনা এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি ও নির্বাচনি ইশতেহার অনুযায়ী প্রতিটি জেলা রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় আনার জন্য রেলপথ মন্ত্রণালয় কাজ করছে। রেল খাতে সেবার মান বাড়িয়ে যুগোপযোগী করে মানুষের চাহিদার কাছাকাছি নিয়ে যাওয়াই আমাদের মূল লক্ষ্য। তিনি বলেন, রেল এখন ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ভবিষ্যতে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার ও চীনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ট্রান্স এশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সে লক্ষ্যে আমরা কাজ শুরু করেছি।