বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১
নূর হোসেন মামুন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:২৪ এএম
আপডেট : ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:০৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের প্রভাব চট্টগ্রাম বন্দরে

খাতুনগঞ্জেও আতঙ্ক
চট্টগ্রাম বন্দর। ছবি : সংগৃহীত
চট্টগ্রাম বন্দর। ছবি : সংগৃহীত

ইসরায়েলে ইরান হামলা চালানোর পর মধ্যপ্রাচ্যে বেড়েছে উত্তেজনা। অঞ্চলটিতে নতুন করে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে সংকটে পড়বে বিশ্ববাণিজ্য। বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যেও পড়তে পারে নেতিবাচক প্রভাব। ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ইরান-ইসরায়েলের মধ্যকার চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে যদি হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে যায়, তবে জ্বালানি আমদানি ও পণ্য রপ্তানিতে মারাত্মক সমস্যায় পড়বে বাংলাদেশ। চলাচল করতে পারবে না বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ। বিশেষ করে প্রভাব পড়বে চট্টগ্রাম বন্দরে। কারণ চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই বেশিরভাগ জাহাজ যায় ওই রুটে। ভিন্ন সামুদ্রিক রুটে জ্বালানি আমদানিতে বাড়বে ব্যয়। আমদানি বিঘ্ন হলে দেশে চলমান লোডশেডিং আরও দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কাও দেখা দেবে। বাড়বে গ্যাসের দামও। এমনকি মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রবাসী আয় আসাও কমে যেতে পারে। বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনাও হবে বাধাগ্রস্ত। ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে পোশাক খাত। প্রভাব পড়বে দেশের সবচেয়ে বড় ভোগ্যপণ্যের বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জেও।

এর আগে গত শনিবার রাতের শেষ প্রহরে সিরিয়ার হামলার পর হরমুজ প্রণালির কাছে একটি জাহাজ জব্দ করে ইরান। প্রথমবারের মতো ইসরায়েলি ভূখণ্ড লক্ষ্য করে শত শত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে তারা। ইরানের এই হামলার পর আবারও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে হরমুজ প্রণালি নিয়ে উত্তেজনা।

জানা যায়, মধ্যপ্রাচ্য থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় তেল রপ্তানি করা হয় হরমুজ প্রণালির মাধ্যমে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল যায় এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকাসহ বিভিন্ন স্থানে। হরমুজ প্রণালির একদিকে আছে আরব দেশগুলো, অন্য পাশে ইরান। পৃথিবীতে যে পরিমাণ জ্বালানি তেল রপ্তানি হয়, তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ হরমুজ প্রণালি দিয়ে যায়।

বিকল্প খুঁজবে বাংলাদেশ: বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ সালে বিপিসি অপরিশোধিত তেল আমদানি করে ১৫ লাখ ৫১ হাজার ৬৪৫ মেট্রিক টন। এ ছাড়া পরিশোধিত তেল জেট এ-১, এসকেও, মোগ্যাস এবং এইচএসডি আমদানি করে ৪৮ লাখ ৫০ হাজার ৮৫১ টন, ফার্নেস অয়েল আমদানি করে ৪ লাখ ৩৫ হাজার ৫৯২ টন। বিপুল পরিমাণ এই জ্বালানির বেশিরভাগই আমদানি হয় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে। তেলবাহী জাহাজগুলো হরমুজ প্রণালি ব্যবহার করে বাংলাদেশে পৌঁছে। কাতার থেকে এলএনজি গ্যাসও আমদানি হয় হরমুজ প্রণালি হয়ে।

ইসরায়েলে ইরানের হামলার পর গবেষণা সংস্থা ইয়ারদেনি রিসার্চের প্রধান এড ইয়ারদেনি বলেন, সাম্প্রতিক এ সংঘাতের ঘটনায় ফের তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলারে উঠে যেতে পারে, যেভাবে ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের পর অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম রেকর্ড বৃদ্ধি পেয়েছিল।

এমন পরিস্থিতিতে জ্বালানি খাতে পড়তে পারে বড় রকমের প্রভাব। সেজন্য বাংলাদেশ বিকল্প জ্বালানি খুঁজবে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু। গত মঙ্গলবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি আয়োজিত সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় এ কথা বলেন প্রতিমন্ত্রী।

বাংলাদেশি জাহাজ চলাচল নিয়ে শঙ্কা: শুধু তেল আমদানি কিংবা পণ্য রপ্তানি নয়, হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজও ওই প্রণালি দিয়ে চলাচল করতে পারবে না। জাহাজ মালিকরা বলছেন, গাজা যুদ্ধের প্রভাবে হুতিরা লোহিত সাগরে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। ফলে আফ্রিকা ঘুরে গন্তব্যে পৌঁছতে হচ্ছে বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকে। এতে পরিবহন ব্যয় ও সময় বেড়েছে। এবার

ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে।

বাংলাদেশ ফ্রেইট ফারোয়ার্ডার অ্যাসোসিয়েশনের (বাফা) ভাইস প্রেসিডেন্ট খায়রুল আলম সুজন কালবেলাকে বলেন, ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে জ্বালানি আমদানিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। অনিরাপদ হয়ে উঠবে হরমুজ প্রণালিসহ আশপাশের সমুদ্র পথগুলো। ভিন্ন পথ ধরে আমদানি করতে গিয়ে সময় ও ব্যয় দুটোই বাড়বে। এখন লোহিত সাগরে হুতিদের আক্রমণের কারণে ব্যয় বেড়েছে। এর সঙ্গে হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে সংকট আরও বাড়বে। কারণ হরমুজ প্রণালিকে এড়িয়ে ভিন্ন রুটে আমদানি-রপ্তানি জাহাজ পরিচালনার সুযোগ খুবই কম। আর যুদ্ধকালীন ভিন্ন পথে কেউ জাহাজ পরিচালনার সাহস দেখাবে বলে মনে হয় না।

ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে পোশাক খাত: বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের প্রধান গন্তব্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ২৭ দেশে পণ্য পৌঁছাতে সুয়েজ খাল ব্যবহার করা হয়। পরিবহন ব্যয়ের ক্ষেত্রেও যা সাশ্রয়ী। এশিয়ার সঙ্গে ইউরোপের যোগাযোগের ক্ষেত্রে সুয়েজ খাল হয়ে স্বল্প পথের ব্যবধানে লোহিত সাগরকে সংযুক্ত করে।

বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য চট্টগ্রাম বন্দর থেকে এ খালের মাধ্যমে লোহিত সাগর দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বন্দরে পৌঁছে। এতে সময় বাঁচে অন্তত ১৫ দিন। এই রুট ব্যবহার করতে না পারলে বিকল্প দক্ষিণ আফ্রিকা হয়ে ইউরোপে যেতে হয়। এতে অতিরিক্ত সাড়ে ৩ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। সময় লাগে বাড়তি ১৫ দিন। বাড়ে পরিবহন ব্যয়ও। সাধারণত ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে ব্র্যান্ড ও ক্রেতারা পরিবহন ব্যয় বহন করে থাকে। তবে বাড়তি ব্যয় শেষ পর্যন্ত রপ্তানিকারক উদ্যোক্তাদের ওপরই চাপানো হয় কৌশলে।

পোশাক মালিকরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যে চরম অস্থিরতার কারণে সাশ্রয়ী এই রুট ব্যবহার করতে না পারলে আটলান্টিক মহাসাগর ব্যবহার করতে হবে। এতে প্রতিযোগিতামূলক বাণিজ্য ব্যবস্থায় বাংলাদেশকে সমস্যায় ফেলবে।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সহসভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, ‘যুদ্ধ যেখানেই লাগুক, সারা বিশ্বেই এর প্রভাব পড়বে। আমরাও ক্ষতিগ্রস্ত হব। রপ্তানিমুখী শিল্প (পোশাক) হওয়ায় বাংলাদেশের ওপর আঘাতটা শুরুতেই আসে। এই যুদ্ধ বাড়তে থাকলে আমাদের ক্ষতিটা সামাল দেওয়া কষ্টকর হয়ে যাবে।

ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের পর থেকেই একটা ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। নতুন করে

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ বেধে গেলে আমাদের টিকে থাকাটাই কঠিন হয়ে পড়বে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের ব্যবসা একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা। শুরু থেকেই আমরা চ্যালেঞ্জের ওপর রয়েছি। তাই সরকারকেও অনুরোধ করব আমাদের সাপোর্ট কিংবা যথাসম্ভব সহযোগিতা করার জন্য। তাহলেই টিকে থাকবে পোশাক খাত।’

বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি নাছির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘লোহিত সাগর সংকট শুরুর পর ঢাকা থেকে ইউরোপে পণ্য পরিবহনে খরচ বেড়ে গেছে।

ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের কারণে তা আরও বাড়তে পারে। এখানে পোশাক রপ্তানির খরচ বেড়ে যাওয়ার চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে, এই সংঘাতের কারণে আমাদের ক্রয়াদেশে মারাত্মক প্রভাব পড়বে। যখন যুদ্ধ হবে, তখন জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাবে; ক্রেতারা কাপড় কেনা কমিয়ে দেবেন। সে কারণে আমরাই প্রথম ক্ষতিগ্রস্ত হব।’

বিকেএমইএর এক নেতা কালবেলাকে বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকেই টালমাটাল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। তখন থেকেই পোশাক খাতের সংকট শুরু। সবচেয়ে বড় সংকট জ্বালানির। এরপর শুরু হলো ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের যুদ্ধ। লোহিত সাগরে হুতি বিদ্রোহ মূলত এই যুদ্ধের সূত্র ধরেই। এখন আবার

ইরান-ইসরায়েল নতুন করে যুদ্ধ লাগলে আরও অনেক দেশ এতে জড়িয়ে পড়তে পারে। এতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাছাকাছি চলে যেতে পারে বিশ্ব। এটিকে কেন্দ্র করে অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়বে। আমরা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হব। বিশেষ করে নিট পোশাক বেশি ক্ষতিতে পড়বে।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

রাত ১টার মধ্যে ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের পূর্বাভাস

বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সুখবর দিল রাশিয়া

ইসরায়েল-হামাস নতুন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে কী থাকছে

‘অপতথ্য রোধে সরকার, পেশাদার গণমাধ্যম এবং সুশীল সমাজ একসঙ্গে কাজ করতে পারে’

বিয়ের দাবিতে প্রেমিকের বাড়িতে তরুণীর অনশন

‘ব্যাংকের সমস্যা নীতি-নির্ধারকদের বোঝানোর মতো লোক প্রয়োজন’

বাড়ছে নদ-নদীর পানি, সিলেটে বন্যার আশঙ্কা

এপ্রিলের শেষ দিনে অস্বাভাবিক রেমিট্যান্স

শাহজাহান কবির বীর প্রতীকের দুটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন 

২৮ পদে শিক্ষকসহ বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারী নেবে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

১০

খালেদা জিয়াকে সিসিইউ থেকে কেবিনে স্থানান্তর

১১

তাপপ্রবাহ নিয়ে জবিতে সচেতনতামূলক সেমিনার

১২

গাজা যুদ্ধ নিয়ে আরব শিক্ষার্থীরা চুপ কেন?

১৩

পড়ার টেবিল নিয়ে ছাত্রলীগের দুপক্ষের সংঘর্ষ

১৪

তীব্র কালবৈশাখী ও ঘূর্ণিঝড়ের দুঃসংবাদ

১৫

পুরুষের তুলনায় বেশি বাঁচলেও অসুস্থ থাকে নারীরা : গবেষণা

১৬

আকাশে মেঘ, মন ভালো নেই বোরো চাষিদের

১৭

আমেরিকাকে ঠেকাতে ভয়ংকর রণতরী নামিয়েছে চীন

১৮

এইচএসসি পাসে কারিতাস বাংলাদেশে নিয়োগ, লাগবে না অভিজ্ঞতা

১৯

যৌনকর্মকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি

২০
*/ ?>
X