বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) গবেষণা করে প্রথমবারের মতো দেশীয় শিং মাছের জিনোম সিকোয়েন্স (জীবনরহস্য) উন্মোচন এবং পুরুষ ও স্ত্রী মাছ নির্ধারণকারী সম্ভাব্য জিন শনাক্ত করেছে। বাকৃবির ফিশারিজ বায়োলজি ও জেনেটিকস বিভাগের অধ্যাপক ড. তাসলিমা খানম এবং তার দল এ গবেষণা করেছে।
২০২০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব অর্থায়নে এ গবেষণা শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে ‘জাপান সোসাইটি ফর দ্য প্রমোশন অব সায়েন্সের (জেএসপিএস) অর্থায়নে ২০২২ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে গবেষণাটি সম্পন্ন হয়। দেশীয় শিং মাছের ৮০০ পোনা নমুনা হিসেবে নিয়ে জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে সিকোয়েন্সিং ও জিন শনাক্তকরণের কাজ করা হয়। সর্বাধুনিক জিনোম সিকোয়েন্সিং প্রযুক্তি ও সুপার কম্পিউটার ব্যবহার করে বায়োইনফরমেটিকস অ্যানালাইসিসের মাধ্যমে জিনোম সিকোয়েন্স সম্পন্ন করা হয়। গবেষণার ফল সম্পর্কে জানাতে গতকাল বুধবার সকাল ১১টায় মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের সম্মেলন কক্ষে এক সংবাদ সম্মেলন করেন প্রকল্পের প্রধান গবেষক ড. তাসলিমা খানম। এতে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমদাদুল হক চৌধুরী, মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল ইসলাম সরদার, ছাত্রবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মো. হারুন-অর-রশিদ, প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. আজহারুল ইসলাম, সহযোগী ছাত্রবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আফরিনা মুস্তারিসহ ইলেকট্রিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সদস্যরা।
ড. তাসলিমা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন, বন্যা, অতিরিক্ত আহরণ ও প্রাকৃতিক আবাসস্থল ধ্বংসের কারণে দেশীয় এ মাছটি বর্তমানে হুমকির সম্মুখীন। ইয়ার বুকস অব ফিশারিজ স্ট্যাটিস্টিক্স অব বাংলাদেশের ২০২০ থেকে ২০২১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী স্বাদুপানির মোট উৎপাদিত মাছের ২ দশমিক ৫২ শতাংশই শিং মাছ। স্ত্রী শিং মাছের বৃদ্ধি পুরুষ শিং মাছ অপেক্ষা ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ বেশি হয়ে থাকে। তাই এই মাছের বাণিজ্যিক উৎপাদন বাড়াতে মনোসেক্স শিং মাছ উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নিই আমরা। এজন্য লিঙ্গ নির্ধারণকারী জিন শনাক্তকরণ অত্যন্ত জরুরি ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব অর্থায়নে শিং মাছের জিন নিয়ে গবেষণা শুরু করি। ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে সংগৃহীত দেশীয় শিং মাছের নমুনা দিয়ে বাংলাদেশ, জাপান ও সুইডেনের একদল গবেষক কাজ শুরু করেন।
তিনি বলেন, গবেষণায় উদ্ভাবিত ড্রাফট জিনোম দিয়ে পুরুষ ও স্ত্রী শিং মাছ শনাক্ত করা যাবে। এর মাধ্যমে শুধু স্ত্রী শিং মাছ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। এতে প্রাকৃতিক জলাশয় ছাড়াও কৃত্রিম পদ্ধতিতে অধিক উৎপাদনশীল স্ত্রী শিং মাছের চাষ করা সম্ভব। জিনোম থেকে শুধু পুরুষ ও স্ত্রী শিং মাছ নির্ধারণকারী জিন ছাড়াও মাছের বৃদ্ধি, রোগপ্রতিরোধ ও প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকা নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। প্রচলিত হরমোন প্রয়োগ পদ্ধতির পরিবর্তে ‘মার্কার অ্যাসিসটেড সিলেকশন (এমএএস) পদ্ধতিতে স্বল্প সময়ে স্ত্রী শিং মাছ উৎপাদন করা সম্ভব হবে, যা অনেক বেশি স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশবান্ধব।
এই গবেষণার ফল চলতি বছরের মার্চে জাপানিজ সোসাইটি অব ফিশারিজ সায়েন্স আয়োজিত একটি আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে উপস্থাপন করা হয়। গবেষণাটির উপাত্ত ওই সম্মেলনে ৩০০ বিজ্ঞানী দ্বারা অনুমোদিত হয়েছে। এ ছাড়া এ গবেষণার ফল বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ হিসেবে প্রকাশের জন্য বর্তমানে সম্পাদনা পর্যায়ে রয়েছে।
বাকৃবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমদাদুল হক চৌধুরী বলেন, হৃদরোগসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্তদের জন্য শিং মাছ অনেক উপকারী। বিশেষ করে রক্তে লোহিত কণিকার পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য এটি বিশেষভাবে সমাদৃত। পুরুষ ও স্ত্রী মাছ নির্ধারণকারী সম্ভাব্য জিন শনাক্তকরণের এ গবেষণার ফল স্ত্রী শিং মাছ শনাক্ত করে এর উৎপাদন বাড়াতে ভূমিকা রাখবে।