রাজন ভট্টাচার্য
প্রকাশ : ২৪ মে ২০২৪, ০২:৩৭ এএম
আপডেট : ২৪ মে ২০২৪, ০৮:৫১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

কাজ করে না ট্রেনের ইঞ্জিন

৬৫-৭০ ভাগ বিকল
কাজ করে না ট্রেনের ইঞ্জিন

ঢাকা থেকে বিকেল সোয়া ৪টায় ছাড়ে আন্তঃনগর সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস। ট্রেনের ইঞ্জিন নিয়ে দুপুর থেকেই চালকদের চোখে-মুখে চিন্তার ছাপ। কারণ, অনেক পুরোনো ইঞ্জিনটির ব্রেকও ঠিকঠাক কাজ করে না। ফ্যান, লাইটসহ প্রয়োজনীয় অনেক কিছু প্রায়ই অকেজো থাকে। সঠিকভাবে কাজ করে না ইলেকট্রিক ডিভাইস।

রেলস্টেশনের এক মাথায় রয়েছে ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ ওয়ার্কশপ। এখানে বিকল ইঞ্জিন মেরামত করা হয়। সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, অনেক ইঞ্জিন মেরামতের জন্য রাখা, সবই পুরোনো। বয়সে বুড়ো। ৩০২৪ নম্বরের একটি নতুন ইঞ্জিনকেও বিকল অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। মেরামত কারখানার বাইরেও রয়েছে বেশ কয়েকটি ইঞ্জিন। প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের অভাবে ইঞ্জিনগুলো সচল করা যাচ্ছে না।

রেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও পার্বতীপুর—তিন জায়গায় অবস্থিত কারখানায় রেলের ইঞ্জিন-বগি মেরামত করা হয়। সব কারখানার চিত্র প্রায় একই। অর্থাৎ তিন স্থানেই বিকল ইঞ্জিনের সারি। রয়েছে ৫৩ বছরের পুরোনো ইঞ্জিনও।

রেলের প্রকৌশল শাখার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নিয়ম অনুযায়ী ২০ ভাগ ইঞ্জিন রিজার্ভ রাখতে হয়। জরুরি প্রয়োজনে এগুলো ব্যবহার করার কথা। বাস্তবতা হলো, একভাগ ইঞ্জিনও রিজার্ভ নেই। বরং ট্রেনের চেয়ে ইঞ্জিনের সংখ্যা কম।

তারা বলছেন, প্রতিটি ইঞ্জিনের আয়ুষ্কাল ২০ বছর। চার যুগের বেশি সময় ধরে জোড়াতালির সংস্কারে এসব ইঞ্জিনে ট্রেন চালানো হচ্ছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে, ইঞ্জিন-বগি মেরামতকারীদের অনেকের চাকরি ছেড়ে পালানোর দশা। ইঞ্জিন সংকটের মুখে মন্ত্রণালয়ের নতুন ট্রেন নামানোর ঘোষণায় তারা আরও সমস্যায় পড়েন। সব মিলিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিনে রেলসেবা কার্যত বন্ধের পথে। যে কোনো সময় ঘটতে পারে বড় বিপর্যয়। বাড়ছে ট্রেন বিলম্বে ছাড়ার ঘটনা ও দুর্ঘটনা।

প্রকৌশলীরা বলছেন, পুরোনো ইঞ্জিনের বেশিরভাগ যন্ত্রাংশ আসে বিদেশ থেকে। সময়মতো টেন্ডার না হওয়া, অল্প দামের যন্ত্রাংশ ব্যবহার, ইঞ্জিনের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম না পাওয়ায় মেরামতের সময় জটিলতায় পড়তে হচ্ছে। সেইসঙ্গে এখন পর্যন্ত রেলের আধুনিক কোনো ওয়ার্কশপ গড়ে ওঠেনি। রয়েছে দক্ষ জনবল সংকট।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতার সময় রেলবহরে ইঞ্জিন ছিল ৪৮৬টি। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৬৩টিতে। এগুলোর ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশই মেয়াদোত্তীর্ণ। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই নতুন ইঞ্জিন কেনা না হলে হুমকিতে পড়তে পারে গোটা রেলব্যবস্থা। রেল কর্তৃপক্ষের দাবি, সংকট কাটাতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ইঞ্জিন সংকট কাটবে।

এদিকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, ময়মনসিংহ, ঈশ্বরদী ও লালমনিরহাটের লোকোশেডের চালকরা গত ১৩ মে পৃথক সভা করে সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলীদের চিঠিতে ট্রেনের জীর্ণদশা তুলে ধরেন। চিঠিগুলোয় ইঞ্জিনের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে যে কোনো সময় সেবা বন্ধ হওয়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করা হয়েছে। সবশেষে এসব চিঠি রেলওয়ে মহাপরিচালকের দপ্তরে পাঠানো হয়।

তবে নতুন ইঞ্জিন কেনার বিষয়ে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এখনো কোনো উদ্যোগ নেয়নি। উল্টো নানা কারণে ইঞ্জিন কেনার প্রকল্প ভেস্তে গেছে। ২০১১ সালের আগস্টে ৭০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন কেনার প্রকল্প নেয় রেলওয়ে। আর ইঞ্জিনগুলো কেনায় চুক্তি সই হয় ২০১৮ সালের অক্টোবরে। এরপর সোয়া তিন বছরেও ঋণের ব্যবস্থা হয়নি। ১৮ থেকে ৬০ মাসের মধ্যে ইঞ্জিনগুলো সরবরাহের কথা ছিল। দুটি প্রতিষ্ঠান ঋণপ্রস্তাব দিলেও কঠিন শর্তের ঋণের কারণে তা নিয়ে আপত্তি তোলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)।

এদিকে তিন বছর পেরোনোয় ইঞ্জিনের দাম ১৬ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান হুন্দাই রোটেম। কিন্তু সে প্রস্তাবে সম্মত হয়নি রেলওয়ে। এতে ৭০ ইঞ্জিন সরবরাহের চুক্তি বাতিল করতে চিঠি দেয় হুন্দাই রোটেম। এর পরিপ্রেক্ষিতে চুক্তি বাতিল করে রেলওয়ে।

চুক্তি অনুযায়ী ৭০টি ইঞ্জিন কিনতে খরচ হতো ২৩ কোটি ৯৪ লাখ ৫৭ হাজার ডলার বা ২ হাজার ৩৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৬৫৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। বর্তমান অবস্থায় ইঞ্জিনগুলো কেনার খরচ বেড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।

রেলওয়ের ২০২২-২৩ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৬০ ভাগ লোকোমোটিভ, ৪৭ ভাগ যাত্রীবাহী বগি ও ৬৭ ভাগ ওয়াগনের আয়ুষ্কাল অতিক্রান্ত হয়েছে। তবে রেলের ট্রাফিক বিভাগ বলছে, এখন ইঞ্জিনের ক্ষেত্রে মেয়াদ শেষ হয়েছে ৬৫ থেকে ৭০ ভাগ পর্যন্ত।

এ সংকটের কথা স্বীকার করে রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী কালবেলাকে বলেন, চট্টগ্রাম দোহাজারী প্রকল্পের আওতায় মিটারগেজে ৫০টি ইঞ্জিন আসবে। তা ছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে রেলওয়েতে ইঞ্জিন সংকট আর থাকবে না। আমরা এই সংকট মোকাবিলার পথ খুঁজছি।

চালকদের কথায়ও ফুটে উঠেছে রেলের জীর্ণদশা। প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী নিয়ে ঢাকা-দেওয়ানগঞ্জ রুটে চলে ‘ভাওয়াল’ এক্সপ্রেস। ট্রেনটিতে ব্যবহার করা হয় ২ হাজার ৩০০ সিরিজের ১৪ নম্বর ইঞ্জিন। কানাডা থেকে ১৯৬৮ সালে কেনা হয় ইঞ্জিনটি, যার মেয়াদ পেরিয়েছে ৩৫ বছর আগেই। ইঞ্জিনের অবস্থা করুণ। কোনো ইলেকট্রিক ডিভাইসই কাজ করে না। তিনটি হ্যান্ডব্রেকের দুটি বিকল। ইঞ্জিনের সেফটি ডিভাইস ডেডম্যান ফুট প্যাডেল দুটিও অকেজো। ইমার্জেন্সি ব্রেক নেই মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিনটিতে। এর রেডিওলোজি সিস্টেমও বিকল হয়ে গেছে বহুদিন আগেই। যাত্রীদের তো বটেই, নিজের নিরাপত্তা নিয়েই শঙ্কিত চালকরা।

তারা বলছেন, বিপজ্জনক ইঞ্জিনের কারণে আমাদের জীবনে নিরাপত্তা নেই। পেটের তাগিদে জোড়াতালির ইঞ্জিন নিয়ে ছুটতে হয় বিভিন্ন প্রান্তে।

কমলাপুরে দেখা যায়, ২ হাজার ৫০০ সিরিজের ইঞ্জিন দিয়ে চলছে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের ট্রেনটির শান্টিংয়ের কাজ। ইঞ্জিনটির ব্রেক চাকার সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে সাধারণ জিআই তার দিয়ে। অকার্যকর সব ইলেকট্রিক ডিভাইস, কাজ করে না ইমার্জেন্সি ব্রেক, এমনকি পায়ের সেফটি ভিডাইসও।

কমলাপুর ওয়ার্কশপের কর্মীরা বলছেন, দেশের ৭০ শতাংশ ইঞ্জিনের মেয়াদ পেরিয়েছে বহু আগেই। পুরোনো ইঞ্জিন মেরামতের যন্ত্রাংশও পাওয়া যায় না এখন।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রেল বিশেষজ্ঞ ড. হাদিউজ্জামান বলেন, দ্রুত নতুন ইঞ্জিন কেনার ব্যবস্থা না করলে রেলের পুরো ব্যবস্থাপনায় বিপর্যয় ঘটবে। রেল দুর্ঘটনা বাড়ছে। বড় বড় প্রকল্প হচ্ছে। এক যুগে রেলের উন্নয়নে ব্যয় হয়েছে দেড় লাখ কোটি টাকা। কিন্তু রেলের নিরাপত্তার জন্য ইঞ্জিন বা বগি কেনা হচ্ছে না। পুরো বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের অদূরদর্শিতা বলে মনে করেন তিনি।

রেল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সারা দেশে যাত্রীবাহী ট্রেনের সংখ্যা ৩২০, আর ইঞ্জিন সংখ্যা ২৩৬। এ বছরই চালু হতে পারে পদ্মা রেল সংযোগের ভাঙ্গা-যশোর অংশ। তবে ইঞ্জিন ও বগি না থাকায় নতুন ট্রেন চালুর সম্ভাবনা কম।

এদিকে আগামী ৩১ মের মধ্যে বগি-ইঞ্জিন সমস্যার সমাধান না হলে কর্মবিরতির হুঁশিয়ারি দিয়ে চিঠি দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট থাকা শ্রমিক-কর্মচারীরা। ঈশ্বরদীর চালকদের অভিযোগ, ওই অঞ্চলের পাঁচটি ট্রেনের ব্রেক পাওয়ার দুর্বল। নতুন কেনা ৩০০০ সিরিজের ট্রাকশন মোটর বিকল বলে জানিয়েছেন ঢাকার শ্রমিক-কর্মচারীরা। এ অঞ্চলের ছয়টি ট্রেনের ব্রেক পাওয়ার দুর্বল বলে অভিযোগ চালকদের।

চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর শ্রমিকদের চিঠিতে বলা হয়েছে, মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পথে বিকল হচ্ছে। চট্টগ্রাম থেকে চলা ছয়টি ট্রেনের ৮০ শতাংশ ব্রেক অকার্যকর। এতে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সিলেটের চালকদের অভিযোগ, জনবল সংকটের তাদের দ্বিগুণ সময় দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। ইঞ্জিনের ব্রেক দুর্বল ও ডেডম্যান ফুট প্যাডেল অকার্যকর বলে জানিয়েছেন ময়মনসিংহের শ্রমিক-কর্মচারীরা।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

শান্তির ডাকে যুদ্ধ আরও জটিল রূপ নিচ্ছে না তো?

ট্রাম্পের হম্বিতম্বির নেপথ্যে কী

নতুন দায়িত্ব নেওয়া ইরানি ড্রোন কমান্ডারকেও মেরে ফেলল ইসরায়েল

অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত মতুয়া সম্প্রদায়ের পাশে পূজা উদযাপন পরিষদ

ময়মনসিংহে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১১

থানায় রক্ষিত বাক্স ভেঙে বের করা হয় এইচএসসির প্রশ্নপত্র

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত / ৫৭ দেশের সহস্রাধিক মুসলিম নেতা বৈঠকে বসছেন আজ

নতুনবাজার অবরোধ করলেন ইউআইইউর শিক্ষার্থীরা

ছাত্রাবাস থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

ইরানের ভূকম্পন কি গোপন পারমাণবিক পরীক্ষা?

১০

দিনে কতবার প্রস্রাব হওয়া স্বাভাবিক? কিডনি সমস্যার লক্ষণ নয়তো

১১

ইরানের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের পরস্পরবিরোধী বার্তা

১২

‘চা-নাশতার’ খরচে মিলছে স্থাপনা নির্মাণের অনুমতি

১৩

তুরস্কে গেছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী

১৪

‘পুরো বিশ্বের সামনে ইসরায়েলকে নত করাবে ইরানের বাহিনী’

১৫

ইরান বলছে কূটনীতির দরজা খোলা, ইসরায়েল জানাল হামলা চলবে

১৬

ঢাকায় বৃষ্টি হলে বাড়বে তাপমাত্রা

১৭

সেপটিক ট্যাংক থেকে দুই শিশুর মরদেহ উদ্ধার 

১৮

আগে বিচার ও সংস্কার পরে নির্বাচন : মুজিবুর রহমান

১৯

দুপুরের মধ্যে যেসব জেলায় হতে পারে বজ্রবৃষ্টি

২০
X