চার দশক আগে রোপণ করা দেশের রাবার গাছগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা অনেকটাই কমে গেছে। এ ছাড়া রাবার প্রসেসিংয়ে চার দশকের পুরোনো যন্ত্রপাতি দিয়ে সনাতন পদ্ধতি ব্যবহার করায় গুণগত মানসম্পন্ন রাবার উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন না হওয়ায় রাবার প্রসেসিং কারখানাগুলো হুমকির মধ্যে পড়েছে। উন্নতমান ও গুণাগুণসম্পন্ন রাবার উৎপাদন করতে না পারায় মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক বাজারে বিএফআইডিসির টিকে থাকা দুরূহ হয়ে পড়েছে।
জানা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএফআইডিসি) ১৮টি রাবার বাগান রয়েছে। এসব বাগানে ৩৮ লাখ ৭৮ হাজার রাবার গাছ রয়েছে। এর মধ্যে ২০ লাখ গাছ উৎপাদনশীল। বাকি গাছগুলো উন্নতমানের ও গুণাগুণসম্পন্ন রাবার উৎপাদন করতে পারছে না। রাবার উৎপাদন করতে না পারা গাছগুলোর মধ্যে ১০ লাখ গাছ ইতোমধ্যে তাদের জীবনচক্র হারিয়েছে, যা মোট গাছের ২৫ শতাংশ।
এমন পরিস্থিতিতে জীবনচক্র হারানো রাবার গাছগুলো কেটে নতুন গাছ রোপণ, রাবার বাগান উন্নয়ন, রাবার প্রসেসিং প্লান্ট আধুনিকায়নের মাধ্যমে গুণগত মানসম্পন্ন কাঁচা রাবার উৎপাদন ও বিপণনের উদ্যোগ নিয়েছে বিএফআইডিসি। এজন্য পরিকল্পনা কমিশনে একটি প্রকল্প প্রস্তাব পাঠিয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশন।
জানা গেছে, বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশনের প্রস্তাবিত ‘অর্থনৈতিকভাবে জীবনচক্র হারানো রাবার গাছ কর্তন, পুনঃবাগান সৃজন ও রাবার প্রক্রিয়াকরণ আধুনিকায়’ শীর্ষক প্রকল্পটি যাচাই-বাছাই করছে পরিকল্পনা কমিশন। আলোচ্য প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ ধরা হয়েছে ১৪৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ১০০ কোটি এবং সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন থেকে খরচ হবে ৪৫ কোটি টাকা। অনুমোদন পেলে চলতি বছরের জুলাইয়ে শুরু হয়ে ২০২৭ সালের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক জীবনচক্র হারানো গাছ কেটে নতুন গাছ রোপণ, গুণগত মানসম্পন্ন কাঁচা রাবার উৎপাদন ও রাবার প্রসেসিং প্লান্ট আধুনিকায়ন। এসবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশনকে একটি প্রতিযোগিতামূলক, আত্মনির্ভরশীল ও স্বয়ম্ভর করপোরেট প্রতিষ্ঠানে উন্নীতকরণ এবং দুর্গম ও পাহাড়ি এলাকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে। প্রকল্পটি চট্টগ্রাম, সিলেট এবং ময়মনসিংহ বিভাগের ৭টি জেলার ১১টি উপজেলায় রাবার বাগান ও ৩টি আঞ্চলিক অফিসে বাস্তবায়িত হবে।
প্রস্তাবনায় বিএফআইডিসি জানিয়েছে, উন্নত মান ও গুণাগুণসম্পন্ন রাবার উৎপাদন করতে না পারায় মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকা দুরূহ হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশনকে একটি প্রতিযোগিতামূলক, আত্মনির্ভরশীল ও স্বয়ম্ভর করপোরেট প্রতিষ্ঠানে উন্নীতকরণে ১৮টি রাবার বাগান উন্নয়ন, রাবার প্রসেসিং প্লান্ট আধুনিকায়নের মাধ্যমে গুণগত মানসম্পন্ন কাঁচা রাবার উৎপাদন ও বিপণনের লক্ষ্যে আলোচ্য প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়েছে, সরকার ১৯৮০ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ২৮ হাজার ৩২৮ হেক্টর অনুর্বর, পতিত, অন্যান্য খাদ্যশস্য ও ফসল উৎপাদনে অনুপযোগী জমিতে রাবার চাষের জন্য ৫ বছরমেয়াদি একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। যার মধ্যে ১৬ হাজার ১৮৭ হেক্টর জমি সরকারি, অবশিষ্ট জমি ব্যক্তি মালিকানাধীন। বর্তমানে বিএফআইডিসির মালিকানাধীন রাবার বাগান রয়েছে ১৮টি। বিএফআইডিসি ১৯৮০-৮১ সাল থেকে উচ্চ ফলনশীল রাবার চারা রোপণ শুরু করে এবং ১৯৯৭ সালের মধ্যে চট্টগ্রাম, সিলেট ও মধুপুরের ১৩ হাজার ২০৭ হেক্টর জমিতে ১৬টি রাবার বাগান সৃজন করে।
বিএফআইডিসির ৩৮ লাখ ৭৮ হাজার রাবার গাছের মধ্যে ২০ লক্ষাধিক গাছ উৎপাদনশীল। রাবার উৎপাদন এবং বিপণনে বিএফআইডিসি ছাড়া বাংলাদেশ পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় ৩ হাজার ৩০০ একর জমিতে ১১টি রাবার বাগান রয়েছে। এ ছাড়া বান্দরবানের ৩২ হাজার ৫৫০ একর জমি ১ হাজার ৩০২ জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ইজারা দেওয়ার পাশাপাশি বহুজাতিক কোম্পানি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তারা ২০ হাজার ৮০০ একর জমিতে রাবার চাষ করেছেন।
বিএফআইডিসির রাবার গাছের মধ্যে প্রায় ১০ লাখ অর্থাৎ মোট গাছের ২৫ শতাংশ অর্থনৈতিক জীবনচক্র হারিয়েছে। একটি রাবার গাছের অর্থনৈতিক জীবনচক্র ধরা হয় ৩২ বছর। এ ছাড়া রাবার প্রসেসিং করার জন্য চার দশকের পুরোনো যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে মানসম্পন্ন রাবার উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না।
প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে ১০টি আধুনিক রাবার প্রসেসিং কারখানা স্থাপন, ১০ লাখ নতুন রাবার গাছ প্রতিস্থাপন, আধুনিক রাবার প্রসেসিং প্লান্ট স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, প্রাকৃতিক রাবারের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণের জন্য ৫টি রাবার টেস্টিং ল্যাব স্থাপন, ৫টি ইটিপি স্থাপন, রাবার সংরক্ষণের জন্য ১০টি ওয়্যারহাউস নির্মাণ এবং হেভি ডিউটি স্কেল ও ফর্ক লিফট সংগ্রহ।