গবেষণায় দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চাহিদার তুলনায় সরকার এখনো অনেক কম বরাদ্দ দেয়। তবে গত ৯ বছরে এ খাতে সরকারি অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ বেড়েছে ১৫ গুণ। যদিও দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে একটি কথা প্রায়ই শোনা যায়—অর্থ বরাদ্দ কম থাকায় অনেকেই গবেষণায় আগ্রহী হচ্ছেন না। এর পরও সরকারিভাবে বরাদ্দকৃত সেই কম টাকা কাঠামোগত অব্যবস্থাপনার কারণে ঠিকমতো খরচ হচ্ছে না। গত ছয় অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দকৃত গবেষণা তহবিলের গড়ে প্রায় ২২ শতাংশ অব্যয়িত রয়ে গেছে। ফলে এ খাতে বরাদ্দ দেওয়া এসব অর্থ সরকারি কোষাগারে ফেরত যাচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সাম্প্রতিক কোনো অর্থবছরেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণার জন্য বরাদ্দকৃত তহবিল পুরোপুরি ব্যয় করতে পারেনি। গত ১২ জুন ইউজিসিতে পূর্ণ কমিশনের সভা হয়। সে সভায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাজেট অনুমোদিত হয়। সভার কার্যবিবরণী থেকে গবেষণায় বরাদ্দ ও অব্যয়িত থাকার এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকের অভিযোগ, গবেষণা খাতে ইউজিসি চাহিদামতো বরাদ্দ দেয় না। আবার গবেষণায় বরাদ্দ পেতেও লবিংয়ের প্রয়োজন হয়। সিস্টেমের এই ত্রুটির কারণে অনেকেই গবেষণায় আগ্রহী হন না। ফলে অর্থ অব্যয়িত থাকে। তবে ইউজিসি কর্মকর্তারা বলছেন, গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দের পর অনেকেই বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যান, অনেকে মৃত্যুবরণ করেন। আবার অনেকে একসঙ্গে একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়ে সবগুলোতে সমানভাবে সময় দিতে পারেন না। সুপারভাইজারের অসুস্থতা বা মৃত্যুর কারণেও কিছু প্রকল্প শেষ করা যায় না। ফলে, প্রতিটি বাজেটে গবেষণার জন্য রাখা তহবিলের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অব্যয়িত থেকে যায়।
২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছর পর্যন্ত ইউজিসি থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণা খাতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৯ বছরে অর্থ বরাদ্দ বেড়েছে ১৫ গুণ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য ২০১৫-১৬ অর্থবছরে গবেষণা অনুদান ছিল ১২.১৬ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১৩৩ শতাংশ অনুদান বাড়িয়ে বরাদ্দ দেওয়া হয় ২৮.৩৭ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আগের অর্থবছরের চেয়ে ৯৩ শতাংশ বরাদ্দ বাড়িয়ে ৫৪.৬৫ কোটি টাকা, পরবর্তী বছর ১৩ শতাংশ বরাদ্দ বাড়িয়ে ৬১.৯০ কোটি, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪ শতাংশ বাড়িয়ে ৬৪.৫৮ কোটি, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৭ শতাংশ বাড়িয়ে ৭৫.৩৯ কোটি, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩২ শতাংশ বাড়িয়ে ৯৯.৭৪ কোটি, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২০ শতাংশ বাড়িয়ে ১২০ কোটি এবং গত অর্থবছরে আরও ২০ শতাংশ বাড়িয়ে ১৪৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। আগামী অর্থবছরের জন্য গবেষণা খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১৮৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি।
ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য ৫৪.৬৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল; কিন্তু খরচ হয়েছে মাত্র ৪৪ কোটি টাকা। বরাদ্দের ১৯.৪৪ শতাংশ খরচ হয়নি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার জন্য প্রায় ৬২ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। তবে এর ২৫.২৬ শতাংশ ব্যয় করা হয়নি। ২০১৯-২০ সালে ৬৪.৫৮ কোটি টাকার তহবিলের ১২.৬৬ শতাংশ অব্যয়িত রয়ে গেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বরাদ্দকৃত ৭৫.৩৯ কোটি টাকার প্রায় ২৯ শতাংশ ব্যয় করা হয়নি। পরবর্তী অর্থবছরে গবেষণার জন্য বরাদ্দকৃত ৯৯.৭৪ কোটি টাকার প্রায় ১৪ শতাংশ ব্যয় করা হয়নি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১২০ কোটি টাকার প্রায় ১১.৩০ শতাংশ অব্যয়িত রয়ে গেছে। বিদায়ী অর্থবছরে গবেষণার জন্য প্রায় ১৪৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে; কিন্তু অর্থবছর শেষ না হওয়ায় ব্যয়ের হিসাব পাওয়া যায়নি।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা দেখভালের দায়িত্বে থাকা ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক মো. সাজ্জাদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, গবেষণার টাকা আমরা একটি প্রকল্পে দিই। দেখা যায়, একজন শিক্ষকের জন্য যখন গবেষণার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়, তখন তিনি হয়তো উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে চলে গেছেন। আবার অনেকে মৃত্যুবরণও করেন। অনেকে গবেষণার কাজ শুরু করে অপারগতা প্রকাশ করেন। এসব কারণে গবেষণার টাকা অব্যয়িত থেকে যায়।
তিনি বলেন, এটা সত্য যে, গবেষণায় যে বরাদ্দ দেওয়া হয় তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। বিশ্ববিদ্যালয় বাড়ছে, গবেষণার চাহিদা বাড়ছে। সে কারণে বরাদ্দ বাড়ানো দরকার। আমরা যে খরচ দিই তা গবেষণার সহযোগিতার জন্য। অবকাঠামোর ব্যবস্থা করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। সেজন্য তারা উন্নয়ন বাজেট পাচ্ছে। সেখানেও বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। পাশাপাশি ইন্ডাস্ট্রিরও এগিয়ে আসা উচিত। কারণ, তাদের অর্থায়নে গবেষণা পরিচালিত হলে তাদেরই লাভ হবে।
শিক্ষকরা জানান, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য বরাদ্দ খুবই কম; কিন্তু সেটি ঠিকভাবে বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রেও অদক্ষতা রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে একজন শিক্ষক একাধিক গবেষণা প্রকল্পের জন্য তহবিল পান, আবার অনেকে একটি গবেষণার জন্যও সরকারি অনুদান পান না। এটিও ইউজিসির প্রতিটি বাজেটে পুরো বরাদ্দ ব্যয় করতে না পারার একটি কারণ হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমআইএস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক (লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সের পিএইচডি গবেষক) আসিফ ইমতিয়াজ বলেন, গবেষণার অর্থ ফেরত যাওয়ার পেছনে কিছু কাঠামোগত কারণ আছে। নতুন গঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হয়তো এখনো গবেষণায় প্রণোদনা প্রদানের নীতি গৃহীত হয়নি। আবার যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েরই গবেষণার প্রাণ হলো তরুণ শিক্ষকরা। তাদের অনেকেই হয়তো উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনে শিক্ষাছুটিতে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দকৃত গবেষণার অর্থ ঠিক কোন উপায়ে কাজ করলে গবেষকের কাছে পর্যন্ত পৌঁছবে, এ ব্যাপারেও অনেক তরুণ শিক্ষক ধোঁয়াশায় থাকেন। এ ছাড়া, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বও তরুণ শিক্ষকদের খানিকটা প্রভাবিত করে। ফলে গবেষণায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করতে তাদের বেগ পেতে হয়।
তিনি বলেন, গবেষণায় বরাদ্দ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্ভারচিত্তে গবেষণার পরিবেশ নিশ্চিত করাটা তাই জরুরি। পাশাপাশি, সরকারি নীতিনির্ধারণে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের গবেষণালব্ধ ফলকে সমন্বিত করার কার্যকরী কৌশল প্রণয়ন করা গেলে শিক্ষকরা গবেষণায় আরও মনোযোগী ও সতর্ক হবেন। সরকারেরও প্রণোদনা থাকবে গবেষণার অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি করে ও গবেষণাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়তা করে আরও বেশি এভিডেন্স-বেইজড পলিসি ফর্মুলেট করার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য বরাদ্দ এত কম যে, এটা দিয়ে ভালো কোনো গবেষণা সম্ভব হয় না। তবে দেশে একেবারেই গবেষণা হয় না, এমনটি নয়। শিক্ষকরা কষ্ট করে যে গবেষণা করেন, তার ফল কাজে লাগান না সরকার বা নীতিনির্ধারকরা। সেক্ষেত্রে আমলা বা রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হয়। এসব কারণে অনেকে গবেষণায় আগ্রহী হন না। গবেষণার অর্থ অব্যয়িত থেকে যায়।
তিনি বলেন, দেশের সিস্টেম গবেষণাবান্ধব নয়। এ দেশে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণা বা পিএইচডি করা আর সাধারণ কোথাও থেকে গবেষণা করাকে একই চোখে দেখা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পদোন্নতির ক্ষেত্রে গবেষণার চেয়ে রাজনৈতিক পরিচয় বেশি জরুরি হয়ে পড়ে। জুনিয়র শিক্ষকরা এসব দেখে
পদ-পদবির তাড়নায় গবেষণায় মনোযোগী হন না। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে গবেষণাকে গুরুত্ব দিতে হবে। গবেষণার জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে। পর্যাপ্ত অবকাঠামোও লাগবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক এম কায়কোবাদ বলেন, দেশ উন্নত করতে হলে ঘর ঝাড়ু দিয়ে হবে না, গবেষক লাগবে। পদ্মা সেতু আমরা করতে পারিনি, কারণ আমাদের সেই মানের গবেষক ও বিশেষজ্ঞ নেই। বড় বড় প্রকল্পে পরামর্শক থেকে শুরু করে কাজ করা পর্যন্ত অনেক টাকা বিদেশে চলে যায়। সেজন্য নিজেদের দক্ষতা অর্জনের বিকল্প নেই। তিনি বলেন, শিক্ষায় বরাদ্দ কম, তাই গবেষণায়ও বরাদ্দ কম। অথচ এই খাতেই সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করা উচিত। সামান্য বরাদ্দ দেওয়ায় অনেকেই গবেষণায় আগ্রহী হন না। আমাদের ত্রুটিপূর্ণ সিস্টেম গবেষক ও শিক্ষকদের নিরুৎসাহিত করছে। তিনি আরও বলেন, গবেষণার অর্থ খরচ না হলে বুঝতে হবে সিস্টেমেই কোনো গলদ রয়েছে। কারণ, কম বরাদ্দের এই দেশে গবেষণার অর্থ অব্যয়িত থাকার কথা নয়। শিক্ষকদের গবেষণার জন্য বরাদ্দ দিলে ভালোমতোই দেওয়া উচিত। এমন অর্থ বরাদ্দ দেওয়া উচিত নয়, যা কোনো কাজে আসবে না। এটা নিয়ে মহাপরিকল্পনা থাকতে হবে।