নারী নির্যাতন প্রতিরোধ আন্দোলন অব্যাহত থাকলেও নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা এতটুকু কমেনি, বরং বেড়েছে বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনরা। লিখেছেন—রীতা ভৌমিক।
সম্প্রতি সাভারে এক মেয়েকে বিবস্ত্র করে ছবি তুলে অনৈতিক কাজে বাধ্য করার চেষ্টা করেছিল মহিলা লীগ নেত্রী পরিচয় দিয়ে। তার একটি চক্র মেয়েদের নানা ধরনের কাজে ব্যবহার করত। সাভারের একজন মেয়েকে তিনি টার্গেট করেছিলেন। মেয়েটিকে দিয়ে অনৈতিক কাজ করাতে না পারায় জোরপূর্বক নেশাদ্রব্য খাইয়ে পাঁচতলা ভবনের ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী গুরুতর আহত হয়ে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। মেয়েটি চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছে।
১৯ আগস্ট সকালে ভুক্তভোগীর মা বাদী হয়ে অভিযোগ করলে মহিলা লীগ নেত্রী পরিচয় দেওয়া মেহনাজ মিশুকে আটক করে রিমান্ডে দিয়েছে পুলিশ।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক তথ্যে জানা যায়, চলতি বছর জুলাই মাসে ২৯৮ নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪১ মেয়েশিশু ও ১৯ নারী। ৭ মেয়েশিশু ও ৯ নারী দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ৫ মেয়েশিশু ও ১ নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। ৯ মেয়েশিশু ও ৭ নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে ৫ মেয়েশিশু ও ৫ নারী। উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছে ৬ মেয়েশিশু ও ১ নারী ইত্যাদি।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম কালবেলাকে বলেন, মহিলা পরিষদ সাভার জেলা কমিটির উদ্যোগে মেহনাজ মিশুকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সরকারও বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। ৯৯৯, ১০৯ ইত্যাদি টোল ফ্রি কলের ব্যবস্থাও করেছে। বেসরকারি সংস্থা ও সংগঠনও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে নানা ধরনের কাজ করছে। এত কাজ করার পরও এর কোনো সফলতা দেখা যাচ্ছে না। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। এ বাস্তবতার সঙ্গে নতুন অপরাধ যুক্ত হয়েছে, এটা হলো সাইবার ক্রাইম। এটা নারীর জীবনে নতুন ধরনের ঝুঁকি আনছে।
তিনি আরও বলেন, আইনের শাসনের মধ্যে দুর্নীতির প্রভাব নারীর অবস্থান নাজুক করছে। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন করতে না পারলে আমরা নারী নির্যাতন বন্ধ করতে পারব না। এ ছাড়া নির্বাচনের আগে এবং পরে নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে যায়। সংখ্যালঘু নারীদের ওপর নির্যাতন শুরু হয়ে যাবে। এই যে সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়া, এ ঘটনাও নারী নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণেও নারী বিচার থেকে বঞ্চিত হয়। ধর্ষণের রায়ে ভিকটিমের সঙ্গে আসামির বিয়ে দিয়ে দেয়। নারীর মানবিক অধিকার আদালতও স্বীকার করছেন না। সরকারের সুশাসন না থাকায় শতচেষ্টায়ও আমরা এ সমস্যা থেকে বের হয়ে আসতে পারছি না।
এক তথ্যে জানা যায়, এ বছর ১ হাজার ৬০৪ জন মেয়েশিশু ধর্ষণ-হত্যা, যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যে জানা যায়, ২০২২-এর জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ৬৪০ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
আসকের সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট আসমা খানম রুবা জানান, গাজীপুরে ছয় মাসে ২৭ জন নারী ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৬৪০ জন। ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছে ২৩ এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছে একজন।
একই সময়ে সারা দেশে যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছে ১৬১ জন নারী। এসব ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছে ৩৭ জন পুরুষ এবং খুন হয়েছে ৫ জন পুরুষ। উত্ত্যক্তের কারণে আত্মহত্যা করেছে দুজন নারী।
সংসদ সদস্য আরমা দত্ত কালবেলাকে বলেন, মানুষ বিশেষ করে পুরুষ মানুষ অনেক বেশি হিংস্র হয়ে ওঠার কারণে নারী নির্যাতন বাড়ছে। এটা সামাজিক ব্যাধি হিসেবে ক্রমেই বাড়ছে। এর ফলে লক্ষ করা যাচ্ছে, মানুষের মধ্যে সহমর্মিতা, নারীর প্রতি শ্রদ্ধা কমছে। তারা নারীকে প্রতিযোগী মনে করছে, সরকার কঠিনভাবে নানা ব্যবস্থার মাধ্যমে নারীর প্রতি সহিংসতাকারীদের শাস্তি দিচ্ছে। কিন্তু এও বুঝতে হবে, সহিংসতা কি রাষ্ট্রের একার পক্ষে নিরসন করা সম্ভব! কারণ এটা সামাজিক ব্যাধি। সমাজকেও রুখে দাঁড়াতে হবে। তিনি আরও বলেন, তরুণ প্রজন্মের নারী-পুরুষ সবাই মিলে সহিংসতা নিরসনে কাজ করতে হবে। পাশের বাড়ির লোকও যদি নারী নির্যাতন করে, তাহলে তাকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সমাজ এগিয়ে এলে এর পরিবর্তন আসতে বাধ্য।
মন্তব্য করুন