বৃহস্পতিবার, ২৮ আগস্ট ২০২৫, ১৩ ভাদ্র ১৪৩২
রীতা ভৌমিক
প্রকাশ : ০৪ মার্চ ২০২৪, ০২:৫৩ এএম
আপডেট : ০৪ মার্চ ২০২৪, ০৮:২৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ট্যাবু ভেঙে নিজেকে প্রকাশ করতে হবে

ট্যাবু ভেঙে নিজেকে প্রকাশ করতে হবে

প্রায় ২০ বছর ধরে আইন পেশার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন চট্টগ্রামের মেয়ে ব্যারিস্টার ইশরাত জেরিন। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কাজ করছেন। এ পথচলায় অনুপ্রেরণা হলেন তার মা হোসনে আরা। নারীরা ভুলেই যান তার নিজেরও মূল্য রয়েছে। নিজেকে কীভাবে মূল্যায়ন করতে হয়, এ শিক্ষাটা তিনি মায়ের কাছ থেকেই শিখেছেন। আরেকটা বিষয় তিনি মায়ের কাছ থেকে শিখেছেন—একজন নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া দরকার সমাজে তার শক্ত অবস্থানের জন্য। জীবনে চলার পথে নানা প্রতিবন্ধকতা আসবে। এ প্রতিবন্ধকতার ক্ষেত্রে নিজের অনুভূতিগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখা দরকার।

তার জন্ম, বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামের নাসিরাবাদে। বাবা দেলোয়ার হোসেন ছিলেন কাস্টমস কর্মকর্তা। বাবার ছিল বদলির চাকরি। ইশরাত জেরিনের প্রাতিষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় বাবার কর্মস্থল সিলেটে। দুই বছর পরপর বাবার কর্মস্থল বদলির কারণে সেখান থেকে তারা ভাইবোনেরা চলে আসেন চট্টগ্রামে। মা তাদের লেখাপড়া, দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে। তিনি চট্টগ্রাম থেকে এসএসসি, এইচএসসি পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলবিতে ভর্তির চান্স পান। কিন্তু রক্ষণশীল বাবা মেয়েকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি যুক্তি দেখিয়েছিলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ও তো ভালো। একা একজন মেয়ে ঢাকা শহরে লেখাপড়া করবে সেটা তিনি মানতে পারছিলেন না। কিন্তু ব্যারিস্টার ইশরাত জেরিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগটা হাতছাড়া করতে রাজি হননি। তিনি বাবার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি। দেশের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগটা কাজে লাগান। আইন পেশায় নিজের ক্যারিয়ার গড়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ১৯৯৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলবিতে ভর্তি হন। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি, এলএলএম ডিগ্রি অর্জন করেন। এখানেই থেমে থাকেননি। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি, লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটি থেকে বিপিটিসি ডিগ্রি অর্জন করেন। ইউকের দ্য বার অব দ্য অনারেবল সোসাইটি অব গ্রেস ইন থেকে ‘ব্যারিস্টার’ উপাধি অর্জন করেন।

ব্যারিস্টার ইশরাত জেরিন তার ক্যারিয়ারে গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইনে লিগ্যাল অ্যান্ড কমপ্লায়েন্সের পরিচালক, তিনটি বড় মাপের মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, এয়ারটেল (ওয়ারিদ টেলিকম)-এর আইনি বিষয় পরিচালনা করেছেন।

ম্যানুফ্যাকচারিং কয়েকটি প্রতিষ্ঠানেও কাজ করেছেন ইশরাত জেরিন। ২০২০ সাল থেকে ইডটকো বাংলাদেশের করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড প্ল্যানিংয়ের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। মালয়েশিয়ান এ কোম্পানির শুধু বাংলাদেশেই নয়, নয়টি দেশে এর অপারেশন রয়েছে। সেখানে নারী কর্মীর সংখ্যাও বেশি। নারী লিডারশিপকে তারা উৎসাহিত করছে।

করপোরেট সেকশনে আরও নারীর সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে ব্যারিস্টার ইশরাত জেরিন বলেন, নারীদের সম্পৃক্ত করার চেয়েও আরও শব্দটি যখন আমি উচ্চারণ করব, তখন বলব অনেকে আছেন। তারপর আরও নারীকে সম্পৃক্ত করব। আমাদের সমাজ এখনো ওই পর্যায়ে আসেনি। করপোরেট সেকশনে নারীর অংশগ্রহণ অনেক কম। বড় কোম্পানি বা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির নেতৃত্ব, নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে বোর্ডরুমে, কখনো হয়তো একজন নারীকে দেখা যায় বা নারীর অংশগ্রহণ নেই এমন দৃশ্যও আমাদের দেশে দেখা যায়।

তিনি বলেন, ইডটকো নারীবান্ধব প্রতিষ্ঠান। তবে এখানে নারী-পুরুষকে সমানভাবে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। সবেতনে ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়া হয়। মাসের বিশেষ দিনগুলোতে নারীর হোম অফিস করার সুযোগও রয়েছে। নারীর মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য সচেতনতার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাউন্সেলিংয়ের সুবিধাও রয়েছে। এখানে আমাকে যেভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে, সে ক্ষেত্রে নারী হিসেবে কোনো সুবিধা পাইনি। আমাকে পুরুষ প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই এখানে আসতে হয়েছে।

ব্যারিস্টার জেরিন আরও বলেন, এখানে নেতৃত্বের ক্ষেত্রে আমি রয়েছি। এটা একটি ইতিবাচক দিক বলে মনে করি। তবে সব সেক্টরে জেন্ডার সমতা নেই। নারী কর্মীর অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে কম দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে সামাজিক-সাংস্কৃতিক কিছু ট্যাবু কাজ করে। প্রথমেই ধারণা করে নেওয়া হয়, সংসারের প্রতি নারীর দায়িত্ব বেশি থাকবে। তাই প্রতিষ্ঠানে সেভাবে দক্ষতা দেখাতে পারবে না। এটাই আমাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের এ ট্যাবু ভেঙে নিজেকে প্রকাশ করতে হবে। নিজের মতামতকে প্রতিষ্ঠিত করা যায় এমন পরিবেশও তৈরি করতে হবে। এ পরিবেশ তৈরিতে নারী-পুরুষ উভয়কে এগিয়ে আসতে হবে। এমনভাবে এগিয়ে আসবে যাতে একজন নারীর মানসিক নিরাপত্তা থাকবে। তার মতপ্রকাশ নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। একজন নারী যেভাবে বলতে চান, সেটার ক্ষেত্রে তার মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব কাজ করবে না। তিনি সহজেই তার মতপ্রকাশ করতে পারবেন। কেন নারীরা করপোরেট সেক্টরে আসছেন না এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা প্রধানত নির্ভর করে নারীর নিজের ওপর। আমাদের দেশে এখনো নারীরা ক্যারিয়ারকে প্রথম পছন্দ হিসেবে না নিয়ে বিকল্প হিসেবে নেয়। একজন নারীর কাছে যখন তার কাজটি বিকল্প হিসেবে থাকে, তখন যে কোনো চ্যালেঞ্জেই তার মধ্যে দ্বিধা কাজ করবে। তিনি ভাববেন, আমি এই কাজটা না করে ওই কাজটা করি। কিন্তু যখন ওই কাজটাই তার কাছে প্রথম পছন্দ থাকবে তখনই তিনি সেই কাজকে প্রাধান্য দেবেন। তিনি তার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাবেন।

ব্যারিস্টার ইশরাত জেরিনের মতে, বিয়ের পর নারীরা পছন্দমতো কাজ করতে না পারার সংখ্যা কমে আসছে। এখন স্বামী-স্ত্রী দুজনে রোজগার করায় সংসার চালানো সহজ হচ্ছে। সংসারে যখন দুজন আর্থিক সহায়তা করছেন, তখন পরিবার থেকেও তাকে উৎসাহিত করা হয়। কিন্তু এটা এমন নয়, তিনি তার ক্যারিয়ারের জন্য কাজ করছেন। সংসারের জন্য অর্থ লাগবে সেজন্য কাজ করছেন বিষয়টা এমন হয়ে দাঁড়ায়। যখন প্রয়োজনটা মিটে যাচ্ছে তখন আর তার গুরুত্ব থাকছে না। আমাদের মানসিকতা এভাবে গড়ে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা মেয়েদের নিজেদের দরকার। এই স্বাধীনতা না থাকলে সমাজে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নিজের অবস্থান তৈরি করা যাবে না যেখানে নারী সিদ্ধান্তের কথা বলতে পারেন।

করপোরেট সেক্টরে নারীর অন্তর্ভুক্তি এখন জরুরি। এখানে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ খুবই কম। সমাজের একটি বড় অংশকে বাদ দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নারীর গুরুত্ব বাড়বে যখন ভিন্ন দক্ষতা, দৃষ্টিকোণ, মতামত নিয়ে পলিসি তৈরি করতে পারবে—বলেন ব্যারিস্টার ইশরাত জেরিন।

তিনি বলেন, দীর্ঘদিন একই পেশায় থাকলে নারী-পুরুষ উভয়ের কাজের অভিজ্ঞতা বাড়ে। অন্যদিকে পুরুষের তুলনায় নারীর কর্মক্ষমতাও বেশি। নারী যতদিন চায় তার ক্যারিয়ারকে চলমান রাখতে পারেন। যদিও করপোরেট সেক্টরে তারুণ্যদের প্রাধান্য দেওয়া হয় বেশি।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসে সব নারীর উদ্দেশে ইশরাত জেরিন বলেন, লক্ষ্য ঠিক করে তাদের লেখাপড়ার পাশাপাশি ক্যারিয়ারের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। কর্মক্ষেত্রে নারী থেকে পুরুষের সংখ্যা বেশি। নিজেকে হেয়প্রতিপন্ন না করে সাহসিকতার সঙ্গে আমাদের সমাজের ট্যাবুগুলোকে ভেঙে এগোতে হবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

জলবায়ু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব অপরিহার্য: উপদেষ্টা

কনভেনশন হলে গেরিলা বৈঠকে গ্রেপ্তার শিমুল ৪ দিনের রিমান্ডে

শাহবাগে এসে ডিএমপি কমিশনারের ‘দুঃখ প্রকাশ’

ইনকিলাব সম্পাদককে লিগ্যাল নোটিশ পাঠাল ছাত্রশিবির

বিএনপি নেতাকে কোপাল যুবলীগ নেতা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাক্ষী হাটহাজারী বিমানবন্দর

ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে রুয়েট শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

ডাকসু নির্বাচন / ১৩২ শিক্ষার্থীকে খাওয়ালেন প্রার্থী, রিটার্নিং কর্মকর্তা বললেন আচরণবিধি লঙ্ঘন

সাদাপাথর লুটপাট নিয়ে সিলেটে গণশুনানি

একাধিক উপকারিতা কাঠবাদামের, যাদের জন্য ক্ষতিকর

১০

একই দিনে দুইবার পরিবর্তন, রাকসু নির্বাচনের নতুন তারিখ নির্ধারণ

১১

পারকি সৈকতের কাজ ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করার নির্দেশ

১২

জয়পুরহাটে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুর্ধর্ষ চুরি

১৩

হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের নামে প্রতারণা, সতর্ক থাকার নির্দেশ

১৪

ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের প্রচারণার ভিডিওতে থাকায় বিপাকে শেবাগ

১৫

ভারতের ছাড়া পানি থেকে বাঁচতেই বাঁধ উড়িয়ে দিল পাকিস্তান!

১৬

সিলেটে পানির জন্য হাহাকার, সড়ক অবরোধ

১৭

অপারেশনের পর জ্ঞান না ফেরায় রোগীর মৃত্যু

১৮

শাহপরাণ (রহ.)-এর মাজারে ওরস বৃহস্পতিবার

১৯

অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য পুলিশ ‘ক্ষমা’ চাইবে, জানালেন ফাওজুল কবির

২০
X