সবকিছু সংস্কারে মূল হলো রাজনীতি। এ সম্পর্কে একটি কথা প্রচলিত আছে তা হলো ‘পলিটিকস ইন কমান্ড’। এ রাজনীতি যদি সঠিকভাবে পরিচালিত না হয় তাহলেই দেশের শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। রাষ্ট্র থেকে মানুষ তাদের কাঙ্ক্ষিত সুযোগ-সুবিধাগুলো তখন আর পায় না। আমাদের দেশে রাজনীতির মোটা দাগে যে বয়ান সেখানে একটির সঙ্গে আরেকটির পার্থক্য অত্যন্ত বিশাল। একটা বয়ান মনে করে—তারা ছাড়া এ দেশে আর কারও রাজনীতি করার অধিকার নেই। তারা অন্যদের অস্তিত্বও অস্বীকার করতে চায়। এ ধরনের বয়ান বা চিন্তাভাবনাই ফ্যাসিবাদের জন্ম দেয়।
গত ১৬ বছরে যারা ক্ষমতায় ছিলেন তারা প্রায়ই বলতেন—এটা বিশ্বাস না করলে তাদের রাজনীতি করার অধিকার নেই, ওটা বিশ্বাস না করলে তাদের রাজনীতি করার অধিকার নেই। ভাবটা এরকম যে, তারা পারলে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে বেআইনি ঘোষণা করে। বিরোধী মতাদর্শের রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়েছে এমন ঘটনাও ঘটেছে। বিগত ১৬ বছরে তাদের প্রয়াস ছিল বাহ্যিকভাবে বহুদলীয় ব্যবস্থা বজায় রেখে কার্যত একটি একদলীয় শাসন কায়েম করা।
তাদের রাজনীতির আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য ক্ষমতা কাঠামো এককেন্দ্রিক করা। আর এই এককেন্দ্রীকরণ এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে, একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর আঙুল হেলানো ছাড়া এ দেশে কোনো সিদ্ধান্তই হবে না। স্বেচ্ছাচার এবং ক্ষমতার কেন্দ্রীভুবন এতটাই খারাপ অবস্থায় গিয়েছিল যে, দেশের মন্ত্রিসভা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছিল। সংসদে কোনো বিরোধী দল ছিল না। ফলে সংসদ একদমই কার্যকর ছিল না। বিরোধী দল নামে যেটা ছিল, তা ছিল সিট ভাগাভাগির এবং সমঝোতার বিরোধী দল। ছিল গৃহপালিত বিরোধী দল।
এই পরিপ্রেক্ষিতে যে রাজনৈতিক সমস্যার উদ্ভব হয়, তা সহজে সমাধান করার নয়। তত্ত্বগতভাবে বলতে হয়, এমন অনেক সমাজ আছে যে সমাজের ভিত্তিমূল স্বৈরতন্ত্রের জন্য উপযোগী। আমাদের সমাজটাও ঠিক সেরকম কি না, তা ভেবে দেখতে হবে। যদি তাই-ই হয়, তাহলে বলব আমাদের উত্তরণের পথটা সহজ হবে না।
আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনা সব থেকে বড় যে ক্ষতিটা করেছে তা হলো—তারা দেশের মুষ্টিমেয় ধনী ব্যবসায়ী পরিবারের সঙ্গে এক ধরনের অশুভ যুগল বন্ধন তৈরি। আর এর পাশে এনে দাঁড় করিয়েছিল পুলিশ, র্যাব, আমলাতন্ত্র এমনকি সামরিক বাহিনীর কিছু ব্যক্তিকেও। এই অশুভ নেক্সাস একে অন্যকে যেভাবে সমর্থন জুগিয়েছে, তাতে অন্যদের পক্ষে তা ছিন্ন করা সম্ভব হয়নি। যখনই কেউ এ নেক্সাস ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে, তার ওপর খড়গহস্ত হয়েছে এই নেক্সাসের দোসররা। বিএনপি অনেকবার চেষ্টা করেছিল কিন্তু তারা এই নেক্সাসের সঙ্গে পেরে ওঠেনি।
ব্যালিংটন মুর তার লেখা বইতে একটি কথা লিখেছিলেন—‘নো বুর্জোয়া নো ডেমোক্রেসি’। অর্থাৎ যে দেশে সুস্থ সুঠাম বুর্জোয়া শ্রেণি গড়ে ওঠে না, সে দেশটা গণতন্ত্রের জন্য উপযোগী নয়। অন্যদিকে আমাদের দেশে স্বাধীনতার পর থেকেই গড়ে ওঠা বুর্জোয়া শ্রেণির দিকে তাকালে শুধু লুণ্ঠনই দেখতে পাই। তারা লুটতরাজ করে ধনী হয়েছে এবং তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের কোনো কাজে আসে না। সমাজের বুর্জোয়ারা যদি এরকম লুণ্ঠনকারী চরিত্রের থেকে যায়, তাহলে তারা এমন কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে দেবে না যেখানে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটে।
আমরা আমাদের পাশের দেশ ভারতের উদাহরণ দিতে পারি। ভারতকে বলা হয় সব থেকে বড় গণতন্ত্রের দেশ। এমনকি আজকের এই নরেন্দ্র মোদির হিন্দুত্ববাদী শাসনামলেও ভারতে গণতন্ত্র কার্যকর রয়েছে। যদিও অনেক অবক্ষয় হয়েছে তবে সেখানে গণতন্ত্র ভেঙে পড়েনি। আর এর অন্যতম কারণ হলো—ভারতের বুর্জোয়া গোষ্ঠী। ভারতে বেশ কিছু ধনী বুর্জোয়া পরিবার রয়েছে যাদের ঐতিহ্য অনেক গভীরে।
কিছু সংস্কার করে দিলে বা কিছু নিয়মকানুন পরিবর্তন করে দিলেই আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকর হয়ে যাবে তেমনটা আমি মনে করি না। তবে এভাবে কিছুটা কাজ হবে, এটা সত্য। তবে তা হবে কসমেটিক চেঞ্জ অর্থাৎ মেকআপ করে সুন্দর দেখানো। আমাদের প্রথমে উচিত সমাজ এবং রাষ্ট্রের সত্যিকার অবস্থাটি বোঝার চেষ্টা করা। আর এখানে সমাজের বুদ্ধিজীবী শ্রেণি বড় ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের রুগণ রাজনীতিকে সুস্থ করে তুলতে হলে হয়তো আমাদের অপেক্ষা করতে হবে যাতে রুগণ রাজনীতি রুগণ হতে হতে একসময় মৃত্যুবরণ করে। নয়তো বিপ্লব দিয়ে সমগ্র রাষ্ট্রকেই নতুন করে গড়তে হবে।
চারদিক থেকে আমরা সংস্কারের দাবি শুনতে পাচ্ছি। আমিও মনে করি নিঃসন্দেহে সংস্কার দরকার। তবে কী সংস্কার করতে হবে এবং কতটুকু করতে হবে তা আগে বুঝতে হবে। আর এটা না বুঝলে আমাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে এবং এর লক্ষণ এরই মধ্যে প্রস্ফুটিত হয়েছে। সমাজে অনেক সময় বিশাল অভ্যুত্থানের পর এনার্কি দেখা দেয়। ফ্রেঞ্চ রেভল্যুশনের পর এমনটাই ঘটেছিল। আমাদের ছাত্র-জনতার অনেক ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে পাওয়া নতুন স্বাধীনতা কোনোভাবেই যেন অশুভ শক্তির দখলে না যায়, সেজন্য সতর্ক থাকতে হবে।
আমাদের সমস্যার পাহাড় হিমালয় পর্বতের মতো উঁচু ও বিশাল। এর শিখরে ওঠা খুব সহজ কাজ নয়। এটাকে যদি সহজে পাড়ি দিতে পারতাম তাহলে বলতে পারতাম যে, হিমালয় পর্বত জয় করেছি। বাংলাদেশের সমস্যাটি হিমালয় পর্বতের সঙ্গে তুলনীয় এবং আমরা রাতারাতি এসব সমস্যার সমাধান করতে পারব না। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার এ দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুমড়ে-মুচড়ে শেষ করে ফেলেছে। দেশের পুলিশ পলাতক। একটা রাষ্ট্রের পুলিশ পালিয়ে যায় এটা আমরা ভাবতেও পারি না। অথচ সেটাই ঘটেছে আমাদের দেশে। যারা কাজে যোগ দিয়েছে তাদের নৈতিক মনোবলের অভাব লক্ষণীয়।
দেশের আইনশৃঙ্খলা ঠিক করাকে সবকিছুর আগে প্রাধান্য দিতে হবে। এজন্য দেশের পুলিশ বাহিনীকে ঢেলে সাজিয়ে নতুন একটি পুলিশ বাহিনী তৈরি করা প্রয়োজন। যদিও সেটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, তবু এটা আমাদের করতে হবে। একই সঙ্গে পুলিশ রেগুলেশনের জন্য বিদ্যমান আইনগুলো কতটা সময়োপযোগী খতিয়ে দেখতে হবে। এসব আইন কতটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপযোগী। বিচার বিশ্লেষণ করে এখানে পরিবর্তন আনতে হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামোকে উন্নত করতে হবে। পরিবর্তনগুলো স্থায়ীভাবে আসবে শুধু একটি নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমেই।
দ্বিতীয়ত, দেশের আমলাতন্ত্র ঠিক করতে হবে। আমলাতন্ত্রে যারা রয়েছেন তাদের অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার সেবক ছিলেন। একই সঙ্গে তারা স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করতে হয় তার সবই করেছেন। এমনকি অনেকে রাজনৈতিক ভাষায় কথা বলেছেন যেটা আদৌ কাম্য নয়। আমলাতন্ত্রকে ঢেলে সাজাতে হবে। এটা না করলে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার এসেও দেশ চালাতে পারবে না।
তৃতীয়ত, আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় ব্যাপক ত্রুটি রয়েছে। একদিকে স্বাস্থ্যসেবা রাজধানী ঢাকায় কেন্দ্রীভূত। অন্যদিকে স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক দুর্নীতি রয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা দুর্নীতিমুক্ত ও বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। একই সঙ্গে সব মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে হবে। অন্তত প্রত্যেকটা জেলায় ভালো হাসপাতাল এবং উন্নত চিকিৎসার সুযোগ তৈরি করতে হবে। যাতে ওই জেলার মানুষ নিজের জেলাতেই সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যসেবা পেতে পারেন।
চতুর্থত, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা কেমন হবে, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা কেমন হবে এখন পর্যন্ত আমরা সেটাই নির্ধারণ করতে পারিনি। আমরা পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করতে পারিনি। আমাদের শিক্ষার মানে প্রচণ্ড অবনতি ঘটেছে। শিক্ষকদের নৈতিকতার এবং তাদের জ্ঞান গাম্ভীর্যের অধঃপতন ঘটেছে। শিক্ষাব্যবস্থার দ্রুত পরিবর্তন না করতে পারলে এ জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
পঞ্চমত, আমাদের বিচারব্যবস্থারও সংস্কার প্রয়োজন। আদালতে দলীয়ভাবে বহু বিচারপতি নিয়োগ হয়েছে। তারা আবার গর্ব করে নিজেদের বলছেন শপথবদ্ধ রাজনীতিক। এ শপথবদ্ধ রাজনীতিকদের বিচারক হিসেবে থাকা উচিত নয়। বিচারপতি কারা হবেন তার মাপকাঠিও নির্ধারণ ও তার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন দরকার। ভালো মাপকাঠি না থাকার কারণেও বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে এ অনাচারগুলো হয়েছে। উচ্চ আদালতের পাশাপাশি নিম্ন আদালতেরও সংস্কার দরকার।
আইনশৃঙ্খলা, আমলাতন্ত্র, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিচারব্যবস্থা ছাড়াও আমাদের রাষ্ট্রীয় পরিষেবাগুলোর সংস্কার আশু জরুরি। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে উন্নত করতে হবে। দেশের বিদ্যুৎসেবা উন্নত করতে হবে এবং এই খাতকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। সর্বশেষ বলতে চাই, আমরা যতগুলো সেক্টরের সংস্কার করব সেখানে লক্ষ রাখতে হবে যেন তা টেকসই হয়। সমাজে ক্ষমতার বিন্যাস প্রচণ্ডভাবে অসম। সমাজে ক্ষমতার প্রতিযোগিতা ও জবাবদিহির জায়গা তৈরি করতে হবে, তাহলে আমরা গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যেতে পারব।
আমাদের দুর্ভাগ্য নতুন পরিস্থিতিতে পুরোনোরা বিদায় নিয়েছে এবং সেই জায়গায় নতুন দখলবাজদের উৎপত্তি হয়েছে। এ দখলবাজদের নিরস্ত্র করতে না পারলে আমাদের সব চেষ্টা ও ত্যাগ ব্যর্থ হয়ে যাবে। সুতরাং এ নব্য দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে এবং খুব শক্ত হাতে তাদের দমন করতে হবে।
যেই ঐক্যের মাধ্যমে আমরা একটি শক্তিশালী স্বৈরতন্ত্রকে বিদায় করেছি, যাকে বিদায় করতে গিয়ে সহস্রাধিক ছাত্র-জনতাকে জীবন দিতে হয়েছে, হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছে... সেই ঐক্যকে বিনষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। এত ত্যাগ, এত রক্ত বৃথা যেতে দেওয়া যাবে না। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত সংস্কারের বিষয়গুলো ফায়সালা না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ থেকে কাজ করার আহ্বান জানাচ্ছি। মনে রাখতে হবে ষড়যন্ত্র এখনো চলছে। এই মহা অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্য একের পর এক ষড়যন্ত্র চলছে। এ ষড়যন্ত্রের বাসাকে ভেঙে দিতে হবে। আর এটা এককভাবে কোনো একটি দলের পক্ষে বা একটি বাহিনীর পক্ষে সম্ভব নয়। প্রয়োজন বিশাল জাতীয় ঐক্যের। আমাদের প্রতিমুহূর্তে সাবধান থাকতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আমার একটাই বার্তা, সেটা হলো—সমাজে নতুন করে অনাচার, স্বেচ্ছাচার, দখলবাজি, দুর্নীতি যাতে না হয় তার জন্য সচেষ্ট থাকবে, একই সঙ্গে পরস্পর ঐক্যবদ্ধ থাকবে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর অন্যান্য দলের মধ্যে এরই মধ্যে পরস্পরের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতে দেখা গেছে। তাদের মনে রাখতে হবে ষড়যন্ত্র এখনো শেষ হয়নি। তারা যদি মনে করে থাকে সব বিপদ কেটে গেছে, তাহলে ভুল করবে। যারা এ কথাকাটাকাটি বা বিবাদে লিপ্ত হচ্ছেন, তাদের প্রতি আমার আবেদন, দয়া করে পরাজিত অশুভ শক্তির ষড়যন্ত্রকে ক্ষুদ্র করে দেখবেন না।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও প্রাবন্ধিক