সমাজে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে হলে নারী-পুরুষ উভয়ের সমান গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পোন্নয়নসহ অন্য পেশায় নারী-পুরুষের সমান ভূমিকা থাকলে রাষ্ট্র উন্নতির উচ্চ শিখরে আরোহণ করতে পারে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগ থেকে সহস্র বছরের ইসলামী খেলাফতের যুগে নারী জ্ঞানচর্চা থেকে শুরু করে আর্থ-সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ভোগ করেছে, তা আধুনিক যুগেও অপ্রতুল। এই সময় তারা বিভিন্ন পেশায় পুরুষের মতো যোগ্যতা ও দক্ষতার পরিচয় দেন। তবে হ্যাঁ, পর্দা-শালীনতা ও ইসলামের ধর্মীয় এবং সামাজিক বিধান-রীতি মান্য করেই তারা তা করেছেন।
ব্যবসা-বাণিজ্যে নারী: রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে নারীরা ব্যবসা-বাণিজ্যও করতেন। কায়লা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কোনো ওমরাহ আদায়কালে মারওয়া পাহাড়ের পাদদেশে আমি তাঁর কাছে উপস্থিত হয়ে বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল (সা.) আমি একজন নারী (ব্যবসায়ী)। আমি কেনাবেচা করি। আমি কোনো জিনিস কিনতে চাইলে আমার কাঙ্ক্ষিত মূল্যের চেয়ে কম দাম বলি। এরপর দাম বাড়িয়ে বলতে বলতে আমার কাঙ্ক্ষিত মূল্যে গিয়ে পৌঁছি। আবার আমি কোনো জিনিস বিক্রি করতে চাইলে কাঙ্ক্ষিত মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্য চাই। এরপর দাম কমাতে কমাতে অবশেষে আমার কাঙ্ক্ষিত মূল্যে নেমে আসি।’ তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘হে কায়লা, এরূপ করো না। তুমি কিছু কিনতে চাইলে তোমার কাঙ্ক্ষিত মূল্যই বলো, হয় তোমাকে দেওয়া হবে, নয় দেওয়া হবে না। তিনি আরও বলেন, তুমি কোনো কিছু বিক্রি করতে চাইলে তোমার কাঙ্ক্ষিত দামই চাও, হয় তুমি দেবে অথবা না দেবে।’ (ইবনে মাজাহ: ২২০৪)
রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বে নারী: ইসলামের সোনালি যুগে নারীরা রাজনীতির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে না থাকলেও তারা বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব করেছেন এবং রাজনৈতিক সংকট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। মুয়াবিয়া ও আলী (রা.)-এর মধ্যকার সংকট নিরসনে আয়েশা (রা.) এগিয়ে আসেন। তেমনি সাওদা বিনতে আম্মারা বিন আশতার হামদানি তার গোত্রের প্রতিনিধি হয়ে মুয়াবিয়া (রা.)-এর কাছে যান এবং দাবি ও প্রত্যাশার কথা তুলে ধরেন। মুয়াবিয়া (রা.) তাদের দাবি মেনে নেন এবং ইবনে আশতারকে বরখাস্ত করেন। (ইকদুল ফারিদ, পৃষ্ঠা: ৩৪৪-৪৬)
নারী চিকিৎসক: রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে নারীরা চিকিৎসক হিসেবেও দক্ষতা অর্জন করেন, তারা শল্যবিদ্যায়ও পারদর্শী ছিলেন। আয়েশা (রা.) নিজেও চিকিৎসাবিজ্ঞানে দক্ষতা অর্জন করেন। উরওয়া (রহ.) বলেন, ‘আমি চিকিৎসাবিজ্ঞানে আয়েশা (রা.) অপেক্ষা দক্ষ আর কাউকে দেখিনি। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, খালা, আপনি এই জ্ঞান কোথা থেকে অর্জন করলেন?’ তিনি বলেন, ‘আমি মানুষকে রোগীর চিকিৎসা করতে দেখেছি এবং তা মনে রেখেছি’। (সিয়ারু আলামুন নুবালা: ২/১৮২)। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, উম্মে সুলাইম (রা.) ও তার সঙ্গের আনসার নারীদের নিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন। যুদ্ধক্ষেত্রে তারা পানি পান করাতেন এবং আহতদের জখমে ওষুধ লাগিয়ে দিতেন (আবু দাউদ: ১৫৭৫)। মিশরে মুসলিম শাসক কর্তৃক প্রথম আবাসিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেখানে নারীরাও চিকিৎসক ও শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগ পান। তাদের কেউ কেউ ‘মাশিখাতুত-তিব’ (প্রধান অধ্যাপক) পদেও অধিষ্ঠিত হন। বিখ্যাত চিকিৎসক শিহাবুদ্দিন আহমদের মেয়ে কায়রোর দারুশ-শিফা মানসুরিয়ার ‘মাশিখাতুত-তিব’ পদে দায়িত্ব পালন করেন। (আহমদ ঈসা বেগ, তারিখুল বিমারিস্তান ফিল ইসলাম)
কৃষিকাজে নারী: মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর যুগে নারীরা কৃষিকাজেও অংশগ্রহণ করতেন। আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘যখন জুবায়ের আমাকে বিয়ে করেন, তখন তার কোনো ধনসম্পদ ছিল না, এমনকি কোনো স্থাবর জমিজমা, দাস-দাসীও ছিল না, শুধু কুয়া থেকে পানি উত্তোলনকারী একটি উট ও একটি ঘোড়া ছিল। আমি তার উট ও ঘোড়া চরাতাম, পানি পান করাতাম এবং পানি উত্তোলনকারী মশক ছিঁড়ে গেলে সেলাই করতাম, আটা পিষতাম; কিন্তু ভালো রুটি তৈরি করতে পারতাম না।’ রাসুল (সা.) জুবায়েরকে একখণ্ড জমি দিলেন। আমি সেখান থেকে মাথায় করে খেজুরের আঁটির বোঝা বহন করে আনতাম। ওই জমির দূরত্ব ছিল প্রায় ২ মাইল। একদিন আমি মাথায় করে খেজুরের আঁটি বহন করে নিয়ে আসছিলাম। এমন সময় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো, তখন রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে কয়েকজন আনসারও ছিলেন। নবী (সা.) আমাকে ডাকলেন এবং আমাকে তাঁর উটের পিঠে বসার জন্য উটকে আখ! আখ! বললেন, যাতে উটটি বসে এবং আমি তার পিঠে আরোহণ করতে পারি।’ (বুখারি: ৫২২৪)
হস্তশিল্পে নারী: মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর যুগে নারীরা হস্তশিল্পের কাজ করেও অর্থ উপার্জন করতেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বপ্রথম সেই আমার সঙ্গে মিলিত হবে, যার হাত সর্বাধিক লম্বা।’ সুতরাং তারা নিজ নিজ হাত মেপে দেখতে লাগলেন কার হাত বেশি লম্বা। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘অবশেষে আমাদের মধ্যে জয়নবের হাতই সবচেয়ে লম্বা স্থির হলো। কেননা, তিনি হাত দিয়ে কাজ করতেন এবং দান-খয়রাত করতেন’ (মুসলিম: ৬০৯৪)। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর স্ত্রী রায়িতা (রা.) হস্তশিল্পে দক্ষ ছিলেন। তিনি বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে তা বিক্রি করতেন এবং উপার্জিত অর্থ দান করে দিতেন। (মুসনাদে আহমদ: ১৬০৩০)
সমাজসেবায় নারী: ইসলামের সোনালি যুগে নারীরা বিভিন্ন ধরনের সমাজসেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ করতেন। তারা অসংখ্য শিক্ষা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। খলিফা হারুনুর রশিদের স্ত্রী জোবায়দা দীর্ঘ খাল খনন করে হাজিদের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করেন। সেলজুক শাসক সুলতান মালিক শাহর স্ত্রী তুরকান বিনতে তুরাজ বাগদাদে তিনটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন এবং তা পরিচালনার জন্য বিপুল পরিমাণ সম্পদ ওয়াকফ করেন (তারিখু দাওলাতুল আব্বাসিয়া, পৃষ্ঠা: ৯৭)। এ ছাড়া একাদশ শতাব্দীতে মামলুক শাসনামলে মুসলিম নারীরা দামেস্কে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় ও ১২টি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন, যা নারীদের দ্বারাই পরিচালিত হতো।
অন্যান্য পেশায় নারী: স্পেনের অধিবাসী আয়েশা বিনতে আহমদ বিন কাদিম ছিলেন ক্যালিগ্রাফি শিল্পী। লুবনি (রহ.) ছিলেন বিশিষ্ট ভাষাবিদ ও আরবি ব্যাকরণশাস্ত্রে পারদর্শী। রাবিয়া কসিসাহ সুপ্রসিদ্ধ বক্তা ছিলেন। শিফা বিনতে আবদিল্লাহ ছিলেন প্রখ্যাত আইনজ্ঞ। ওমর (রা.) তাকে ইসলামী আদালতের ‘কাজাউল হাসাবাহ’ ও ‘কাজাউস সুক’ ইত্যাদির দায়িত্বভার অর্পণ করেন। (তাবকাতে ইবনে সাদ: ৮/৪৫-৪৮; আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৫/৭৮)