শুক্রবার, ২৯ আগস্ট ২০২৫, ১৪ ভাদ্র ১৪৩২
রাশেদ রাব্বি
প্রকাশ : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩:১০ এএম
আপডেট : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯:৫৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

স্বল্পতা-সীমাবদ্ধতায় দেশের ক্যান্সার চিকিৎসা

ব্যয়বহুল চিকিৎসা
স্বল্পতা-সীমাবদ্ধতায় দেশের ক্যান্সার চিকিৎসা

চার দশকেরও আগে দেশে ক্যান্সার বা কর্কট রোগের চিকিৎসা শুরু হলেও এই দীর্ঘ সময়েও তা পূর্ণতা পায়নি। দেশের একমাত্র যে সরকারি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানটি রয়েছে, সেটি ধুঁকছে জনবল ও যন্ত্রপাতির সংকটে। এই সুযোগে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও এসব প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসাসেবা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। সঙ্গে ওষুধের উচ্চমূল্য তো আছেই। এসব কারণে সাধারণের নাগালের বাইরেই থেকে যাচ্ছে ক্যান্সারের চিকিৎসা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য সব সেবা থাকতে হবে এক ছাদের নিচে, যেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও থেরাপি, চিকিৎসা-পরবর্তী যত্ন ও পুনর্বাসন সেবা মিলবে। বাংলাদেশে সরকারি বা বাণিজ্যিক কোনো পর্যায়েই নেই এ ধরনের সুবিধা। এখন পর্যন্ত দেশে ক্যান্সার শনাক্তে গুরুত্বপূর্ণ মলিকুলার ল্যাব স্থাপনও সম্ভব হয়নি।

বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক বলেন, ‘আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সরকারিভাবে তা অতিক্রমের চেষ্টা করা হচ্ছে। দেশের আট বিভাগে একশ শয্যার ক্যান্সার হাসপাতাল স্থাপনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ভবিষ্যতে টিকা চালুর পরিকল্পনা রয়েছে।’

গ্লোবাল ক্যান্সার অবজারভেটরির তথ্য বলছে, ২০২২ সালে দেশে এক লাখ ৬৭ হাজার ২৫৬ জন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন, যার মধ্যে এক লাখ ১৬ হাজার ৫৯৮ জনের মৃত্যু হয়। তবে প্রতিষ্ঠানটি বলছে, এই তথ্য দেশের প্রকৃত চিত্র প্রকাশ করে না। কারণ, বাংলাদেশে এ-সংক্রান্ত সঠিক তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই।

চিকিৎসা ও উচ্চশিক্ষার সীমিত সুযোগসহ অনেক সীমাবদ্ধতা: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্র প্রয়োজন, যেখানে কেমোথেরাপি, সার্জারি ও রেডিয়েশন থেরাপি থাকতে হবে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি ধরলে এই মানদণ্ডে ১৭০টি চিকিৎসা কেন্দ্র প্রয়োজন। তবে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে চিকিৎসা কেন্দ্র আছে মাত্র ৩৩টি।

দেশে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট আছেন মাত্র ১ দশমিক ৭ জন। এ ছাড়া মেডিকেল ফিজিসিস্ট ২১ দশমিক ৯ জন, সার্জন ১৭ দশমিক ৪ জন, রেডিওলজিস্ট ৩৩ দশমিক ২ জন ও নিউক্লিয়ার মেডিসিন ফিজিশিয়ান আছেন ৬ দশমিক ৬ জন। তবে দেশে কোনো মেডিকেল ও প্যাথলজি ল্যাব সায়েন্টিস্ট নেই।

এ ছাড়া বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার মানুষের মধ্যে মাত্র ৯ দশমিক ৯ জন মেমোগ্রাফির, ২ দশমিক ১ জন এক্সটার্নাল বিম রেডিওথেরাপির, ১২ দশমিক ১ জন সিটিস্ক্যানের ও ৪ দশমিক ৬ জন এমআরআই সুবিধা পায়।

রেডিয়েশন অনকোলজি ও মেডিকেল অনকোলজি বিভাগে বছরে মাত্র ৪ জন করে স্নাতকোত্তর করার সুযোগ পান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ)। অন্যদিকে, রেসিডেন্স হিসেবে প্রতি বছর ১৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পান। তবে তাদের ক্যান্সারের কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ না দিয়ে সব বিষয়ে পড়ানো হয়। ফলে তারা ক্যান্সারের সুনির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে পারেন না।

জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের হেমাটোলজি বিভাগের প্রধান ডা. মোহাম্মদ আলী বলেন, উচ্চশিক্ষার সংকটের পাশাপাশি রয়েছে পদায়নের জটিলতা। হেমাটোলজিতে যারা স্নাতকোত্তর করেছেন তাদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জেলা-উপজেলায় পদায়ন করা হয়। অথচ সেখানে তাদের কাজের সুযোগ সীমিত।

ব্যয়বহুল চিকিৎসা: গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে একজন ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসায় বছরে আনুমানিক ৬ লাখ ৩৯ হাজার টাকা ব্যয় হয়। এর মধ্যে আছে চিকিৎসকের পরামর্শ ফি, রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অস্ত্রোপচার বা চিকিৎসা, ওষুধ, ইনজেকশন সামগ্রী, যাতায়াত, রোগী ও স্বজনদের থাকা-খাওয়ার খরচ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, মূল চিকিৎসার বাইরে অন্য যে খরচ রোগী ও তার স্বজনদের করতে হয়, তা অনেক বেশি। ক্যান্সার শনাক্ত করা বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য মানুষকে নানা জায়গায় ঘুরতে হয়। অনেকে দালাল চক্রের খপ্পড়ে পড়েন। প্রতিটি ক্ষেত্রে পকেট থেকে অর্থ ব্যয় হয়।

যেসব প্রতিষ্ঠানে মেলে ক্যান্সারের চিকিৎসা: সরকারি পর্যায়ে ক্যান্সার চিকিৎসার একমাত্র বিশেষায়িত কেন্দ্র জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। এ ছাড়া ঢাকা, স্যার সলিমুল্লাহ, ময়মনসিংহ, সিলেটে ওসমানী, রাজশাহী, রংপুর, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর, বগুড়া এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ক্যান্সার বিভাগ রয়েছে। বিএসএমএমইউর ক্লিনিক্যাল অনকোলজি, গাইনোলজিক্যাল অনকোলজি, পেডিয়াট্রিক হেমাটোলজি অ্যান্ড অনকোলজি ও রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগ রয়েছে। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালেও অনকোলজি বিভাগ রয়েছে।

বেসরকারি পর্যায়ে ক্যান্সার চিকিৎসায় বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে আহসানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতাল। এ ছাড়া মিরপুরের ডেলটা হাসপাতাল, সাভারের এনাম মেডিকেল, ইউনাইটেড হাসপাতাল, স্কয়ার হাসপাতাল, ল্যাবএইড হাসপাতাল ও এভারকেয়ার হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসা হয়। ঢাকার বাইরে আছে বগুড়ার ঠ্যাঙ্গামারা মেডিকেল, সিরাজগঞ্জের খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল, সিলেটের রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল, সিলেটের ইস্টওয়েস্ট মেডিকেল, চট্টগ্রাম এভারকেয়ার হাসপাতাল এবং চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল। তবে পরিপূর্ণ ক্যান্সার সেবা নেই কোথাও।

কেমোথেরাপি সেবা একেবারেই অপ্রতুল: ক্যান্সার চিকিৎসায় কেমোথেরাপি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই থেরাপি প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষ প্রটোকল মানার নির্দেশনা রয়েছে। বিশেষ করে কেমোর ওষুধ মিশ্রণের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ফার্মাসিস্টদের অংশগ্রহণ জরুরি। অথচ জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ছাড়া অন্য কোথায়ও এই সুবিধা নেই।

রেডিয়েশন থেরাপিও মিলছে না অনেক হাসপাতালে: বেসরকারি পর্যায়ে রাজধানীর ডেলটা হাসপাতালে রেডিয়েশন থেরাপির যন্ত্র আছে ৫টি। এর মধ্যে দুটি অত্যাধুনিক লিনিয়ার এক্সিলারেটর। আহসানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতালে যন্ত্র আছে ৩টি, এর মধ্যে দুটি লিনিয়ার এক্সিলারেটর। এ ছাড়া ইউনাইটেড হাসপাতালে দুটি, ল্যাবএইড হাসপাতালে দুটি, সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুটি এবং এভারকেয়ার হাসপাতালে একটি যন্ত্র রয়েছে।

সরকারি পর্যায়ে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে বিকিরণ যন্ত্র রয়েছে ৬টি। তবে এসব যন্ত্র বিকল পড়ে আছে। বিএসএমএমইউর ক্যান্সার ইউনিটে একটি ও ঢাকা মেডিকেলে রয়েছে দুটি যন্ত্র। বগুড়া, চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ, রংপুর, রাজশাহী ও বরিশাল মেডিকেল কলেজে একটি করে রেডিয়েশন যন্ত্র আছে। এ ছাড়া ফরিদপুর ও খুলনা মেডিকেল কলেজে একটি করে লিনিয়ার এক্সিলারেটর যন্ত্র থাকলেও দীর্ঘদিন বাক্সবন্দি অবস্থায় অব্যবহৃত পড়ে আছে। এসব হাসপাতালে সব মিলিয়ে থাকা ১২টি রেডিয়েশন যন্ত্রের মধ্যে সচল মাত্র দুটি।

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন: সামগ্রিক বিষয়ে ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোল্লা ওবায়েদুল্লাহ বাকী বলেন, আগের তুলনায় দেশে ক্যান্সার চিকিৎসার পরিধি বাড়লেও চাহিদার তুলনায় তা অপ্রতুল। দেশে যন্ত্রপাতির মারাত্মক সংকট রয়েছে। ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়লেও সেবার পরিধি বাড়েনি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য একটি ক্যান্সার কেন্দ্র দরকার। সারা দেশে ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন ১২০ জন। ক্যান্সার সেবায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কোনো সেবিকা নেই। ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে কিছু আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকলেও অন্য সরকারি হাসপাতালগুলোয় তা নেই।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সাবেক এমপি বুলবুলের পিএস সিকদার লিটন গ্রেপ্তার

টাকা না পেয়ে ফুপুকে গলাকেটে হত্যা করল ভাতিজা

প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে নারীদের জন্য বিশেষ কোটা বাতিল 

আন্তর্জাতিক ফেলোশিপে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন ছাত্রদলের ঊর্মি

স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে বাসায় ফিরেছেন খালেদা জিয়া

সাতক্ষীরার পুলিশ সুপারের মায়ের মৃত্যুতে প্রেস ক্লাবের শোক

প্রকৌশলীদের মর্যাদা রক্ষায় আইইবি’র ৫ দফা দাবি

পুলিশের গাড়িতে হামলা চালিয়ে আসামি ছিনতাই

চ্যাম্পিয়ন্স লিগের লিগপর্বের ড্র অনুষ্ঠিত, রিয়াল-বার্সার প্রতিপক্ষ কারা?

সাবেক মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ভিডিওটি ভুয়া

১০

আজীবন থাকা, কাজ ও ব্যবসার সুযোগ দেবে সৌদি, কত টাকা লাগবে

১১

ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক

১২

এবার যুক্তরাজ্য থেকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের 

১৩

ফিফা কোয়ালিফায়ারে শেষবারের মতো নামছেন মেসি, জানালেন নিজেই

১৪

অপারেশন থিয়েটারে রোগীকে রেখে স্বাস্থ্যকর্মীর টিকটক, অতঃপর...

১৫

গকসু নির্বাচন : রেকর্ডসংখ্যক মনোনয়ন বিতরণ 

১৬

চট্টগ্রামে হবে আইইসিসি মাল্টিডেস্টিনেশন এডুকেশন এক্সপো 

১৭

চব্বিশের বিজয়ীদের কার্যকলাপে দেশের মানুষ অতিষ্ঠ : কাদের সিদ্দিকী

১৮

ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে হামলার আশঙ্কা নিয়ে যা বললেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

১৯

প্যানেলে তন্বির জন্য পদ শূন্য রাখলেও একই পদে লড়ছেন বাগছাসের এক নেতা

২০
X