চা—আমাদের অশান্ত মন শান্ত করতে এক কাপ গরম চা যথেষ্ট। চায়ের কাপে চুমুকের সঙ্গে গরম ধোঁয়ায় আমাদের মনের অশান্তিগুলোও যেন উবে যায়। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় কিংবা অফিসে কাজের চাপে মাথা ধরায় এক কাপ চা মুহূর্তেই এনে দেয় অনাবিল প্রশান্তি। এক কাপ চা যে শুধু আনন্দের সঙ্গী তা নয়, বাংলাদেশের জন্য এটি এক মহার্ঘ কৃষিপণ্য—অর্থনীতির এক সম্ভাবনাময় খাত এই চা শিল্প। দেশের শতবর্ষের পুরোনো চা শিল্প এখন নতুন উচ্চতায় পৌঁছাচ্ছে। প্রতি বছর উৎপাদনের রেকর্ড ভেঙে বাংলাদেশ এখন বছরে ১০ কোটি কেজির বেশি চা উৎপাদন করছে। এর বড় একটি অংশ যাচ্ছে বিদেশে, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম উৎস হিসেবে।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে মোট চা উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১০ কোটি ২০ লাখ কেজি, যা ২০২৩ সালের তুলনায় ৪ শতাংশ বেশি। গত এক দশকে চা উৎপাদনে ধারাবাহিক বৃদ্ধির এ প্রবণতা শিল্পটিকে নতুন সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
কোন অঞ্চলে কত উৎপাদন
এখন দেশের প্রধানত তিনটি অঞ্চলে চা উৎপাদন হয়ে থাকে—সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম। এর মধ্যে মৌলভীবাজার জেলার চা-বাগানগুলো এককভাবে দেশের প্রায় অর্ধেক চা উৎপাদন করে। সিলেট ও হবিগঞ্জ মিলে আসে আরও প্রায় ৩৫ শতাংশ। চট্টগ্রাম বিভাগ, বিশেষ করে রাঙ্গুনিয়া, ফটিকছড়ি ও হালিশহর অঞ্চলের পুরোনো বাগানগুলোয় উৎপাদন কিছুটা কম হলেও এখনো উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সাম্প্রতিককালে ক্ষুদ্র চা-চাষিরা গড়ে তুলেছেন শতাধিক নতুন বাগান, যেখান থেকে আসে দেশের প্রায় ৫ শতাংশ চা।
বর্তমানে দেশে ১৬৭টি নিবন্ধিত চা-বাগান ছাড়াও প্রায় আট হাজারের বেশি ক্ষুদ্র চা-চাষি উৎপাদনে যুক্ত হয়েছেন, যা উৎপাদনের পরিমাণ ও বৈচিত্র্য—দুটিই বাড়িয়েছে। শুধু কালো চা নয়, এখন উৎপাদন হচ্ছে গ্রিন টি, হোয়াইট টি ও নানা ধরনের ফিউশন বা ভেষজ চা।
রপ্তানি কত
এ উৎপাদনের বড় একটি অংশ অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটালেও, প্রতি বছর লক্ষণীয় পরিমাণ চা রপ্তানি হয় বিদেশে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ কেজি চা রপ্তানি করেছে, যার বাজারমূল্য প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। চায়ের প্রধান রপ্তানি গন্তব্য দেশের মধ্যে রয়েছে—সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও জাপান। বিশেষ করে স্বাস্থ্যসচেতন ভোক্তাদের মধ্যে বাংলাদেশের গ্রিন ও হোয়াইট টির চাহিদা বাড়ছে ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যে।
বাংলাদেশ চা বোর্ড বলছে, আগামী পাঁচ বছরে চা উৎপাদন ১২ কোটি কেজিতে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এর জন্য আধুনিক কৃষিপদ্ধতি, নতুন জাত উদ্ভাবন এবং বাগান আধুনিকায়নের কাজ চলছে। একই সঙ্গে শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়ন, পানির ব্যবহার কমানো এবং জলবায়ু সহনশীল উৎপাদন ব্যবস্থাও গুরুত্ব পাচ্ছে।
চা শিল্পের চ্যালেঞ্জ
এ শিল্পের সম্ভাবনার সঙ্গে চ্যালেঞ্জও রয়েছে। পুরোনো চা-গাছ, শ্রমিক সংকট, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা অনেক সময় কৃষকদের উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। রপ্তানির ক্ষেত্রে ব্র্যান্ডিং, মান নিয়ন্ত্রণ ও সরবরাহ চেইন দুর্বলতাও সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
চা একসময় শুধু অভিজাতদের পানীয় ছিল, এখন তা ছড়িয়ে পড়েছে গ্রাম থেকে শহরে, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও। সেই চায়ের পেছনে রয়েছে হাজারো কৃষক, শ্রমিক ও উদ্যোক্তার শ্রম ও স্বপ্ন। দেশের চা শিল্পের এই পুনর্জাগরণ শুধু অর্থনীতিই নয়, গ্রামীণ জীবন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কেও নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত খুলে দিচ্ছে।
বাংলাদেশে উৎপাদিত সবচেয়ে দামি ও ব্যতিক্রমী চা
শুধু অর্থনীতির সম্ভাবনাময় খাত ও রপ্তানির আয়ের অন্যতম উৎস নয়, বাংলাদেশের চা শিল্পের ইতিহাসে নতুন মাত্রা যোগ করছে কিছু ব্যতিক্রমী ও দামি চায়ের জাত। একসময় শুধুই কালো চা উৎপাদনে সীমাবদ্ধ এ শিল্প এখন উচ্চমূল্যের হোয়াইট টি, গ্রিন টি এবং হ্যান্ড-প্রসেসড অর্গানিক চায়ের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। এসব চায়ের প্রতি কেজির দাম ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত উঠেছে, যা দেশে উৎপাদিত সাধারণ চায়ের দামের তুলনায় বহুগুণ বেশি। উচ্চমানের অর্গানিক গ্রিন টি এখন দেশের ভেতরে ও রপ্তানির ক্ষেত্রে সমান জনপ্রিয়।
সিলভার নিডল হোয়াইট টি
বাংলাদেশে উৎপাদিত সবচেয়ে দামি চা হচ্ছে সিলভার নিডল হোয়াইট টি। এটি মূলত মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল অঞ্চলের কয়েকটি বিশেষায়িত বাগানে সীমিত আকারে উৎপাদিত হয়। প্রতি কেজি সিলভার নিডলের দাম ৫০ হাজার থেকে ৫৫ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
এ চায়ের বিশেষত্ব হলো এর উৎপাদন পদ্ধতিতে। শুধু সূর্যোদয়ের আগে হাতে তুলে আনা হয় কুঁড়ির মতো নরম চা-পাতা। এরপর সেগুলো প্রাকৃতিক উপায়ে শুকানো হয়—কোনো ধরনের যান্ত্রিক প্রক্রিয়া ছাড়া। এতে ক্যাফেইনের পরিমাণ অত্যন্ত কম, কিন্তু অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের পরিমাণ অনেক বেশি। স্বাস্থ্যসচেতন ভোক্তাদের কাছে এ চায়ের চাহিদা বাড়ছে দেশ-বিদেশে।
অর্গানিক হোয়াইট টি
এ ছাড়া অর্গানিক হোয়াইট টি বাংলাদেশের আরেকটি দামি চায়ের নাম। এটি মৌলভীবাজার, সিলেট এবং বান্দরবান অঞ্চলের কিছু ক্ষুদ্র চা-বাগানে উৎপাদিত হয়। কেজিপ্রতি এর দাম ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। রাসায়নিকমুক্ত ও পরিবেশবান্ধব চাষ পদ্ধতির কারণে এটি ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানিযোগ্য পণ্যে পরিণত হয়েছে।
গোল্ডেন টিপস
আরেকটি ব্যতিক্রমধর্মী চা হলো গোল্ডেন টিপস। এটি উৎপাদিত হয় কিছু পুরোনো এবং উন্নত চা-বাগানে, যেমন জালালাবাদ ও লালছড়ি বাগানে। প্রতি কেজি গোল্ডেন টিপসের বাজারমূল্য ১৫ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা। এ চা-পাতাগুলো দেখতে সোনালি রঙের হয় এবং সেগুলো সুগন্ধযুক্ত, সুস্বাদু ও বহুদিন সংরক্ষণযোগ্য।
গ্রিন টি ও ফিউশন চা
উচ্চমানের অর্গানিক গ্রিন টি এখন দেশের ভেতরে ও রপ্তানির ক্ষেত্রে সমান জনপ্রিয়। প্রতি কেজির দাম ৮ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যে। সিলেটের কয়েকজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এই গ্রিন টি উৎপাদন করে সরাসরি জার্মানি, জাপান ও সৌদি আরবে রপ্তানি করছেন।
তা ছাড়া আয়ুর্বেদিক ফিউশন চা—যাতে তুলসী, আদা, লেবু বা গোলাপের পাপড়ির মিশ্রণ থাকে—তা এখন দেশ ও বিদেশে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির ভোক্তাদের কাছে বেশ চাহিদাসম্পন্ন। এসব চায়ের দাম কেজিপ্রতি ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়।
মন্তব্য করুন