দুই বছর আগে পাকিস্তানে যে দৃশ্য ছিল, সেটি ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য এক বিভীষিকাময় অধ্যায়। ২০২৩ সালের ৯ মে ইমরান খানের গ্রেপ্তারকে কেন্দ্র করে সেদিন জনরোষে ফেটে পড়ে পুরো পাকিস্তান।
লাহোরে এক জেনারেলের বাড়িতে আগুন, রাওয়ালপিন্ডিতে সেনা সদর দপ্তরে হামলা- সব মিলিয়ে সেনাবাহিনীর জন্য তা ছিল জনসমর্থনের সবচেয়ে বড় ধস। পাকিস্তানে সামরিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে এমন তীব্র প্রতিক্রিয়া এর আগে আর কখনো দেখা যায়নি।
কিন্তু ২০২৫ সালের মে মাসে সেই চিত্র যেন মুছে গেছে। ভারতের সঙ্গে চার দিনের সীমান্ত সংঘর্ষ পাকিস্তানের অভ্যন্তরে যে জাতীয়তাবাদী আবেগ সৃষ্টি করেছে, তা সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তিকে উল্টো ঘুরিয়ে দিয়েছে। এক সময় যাদের বিরুদ্ধে স্লোগান উঠেছিল, তারাই আজ জাতীয় বীর। আর এই পালাবদলে বড় ভূমিকা রেখেছে ভারত।
২২ এপ্রিল ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন। ভারত সরাসরি এই ঘটনার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীর ও পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এই হামলায় প্রাণ হারায় ৫১ জন, যার মধ্যে ১১ জন ছিলেন পাকিস্তানি সেনাসদস্য এবং কয়েকজন শিশু।
পরবর্তী তিন দিন দুই দেশের মধ্যে চলে ড্রোন, আর্টিলারি ও ক্ষেপণাস্ত্র বিনিময়। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর এত বড় সামরিক উত্তেজনা আর দেখা যায়নি। কিন্তু এই সংঘর্ষ পাকিস্তানে জাতীয়তাবাদ উসকে দেয়।
সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জনরোষ নিমেষে রূপ নেয় সমর্থনের জোয়ারে। পাক-ভারত যুদ্ধবিরতির পর শহরের রাস্তায় দেখা যায় মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা, বাজছে দেশাত্মবোধক গান, জাতীয় পতাকা হাতে মানুষ একাত্মতা প্রকাশ করছে তাদের সেনার সঙ্গে।
গ্যালাপ পাকিস্তানের সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, ৯৬ শতাংশ মানুষ মনে করছে পাকিস্তান এই সংঘর্ষে জয়ী হয়েছে। ৮২ শতাংশ সেনাবাহিনীর পারফরম্যান্সকে বলেছে ‘খুব ভালো’। আর ৯২ শতাংশ বলেছে, সেনাবাহিনীর প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে ইতিবাচকভাবে।
বিশ্লেষকদের মতে, এটি এক ধরনের ‘র্যালি অ্যারাউন্ড দ্য ফ্ল্যাগ’ প্রভাব- যেখানে বাইরের হুমকি এলে অভ্যন্তরীণ বিরোধ সাময়িকভাবে চাপা পড়ে যায়। আর তাতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি চিরচেনা ন্যারেটিভ হলো- পূর্ব সীমান্তে শত্রু সবসময় সক্রিয়, তাই আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। ভারতের সাম্প্রতিক হামলা এই বার্তাকে নতুন করে কার্যকর করে তুলেছে। প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ১০ মে দিনটিকে ঘোষণা করেছেন ‘বুনিয়ান মারসুস দিবস’- যার মানে ‘সিসায় গাঁথা প্রাচীর’। সেনাবাহিনীর প্রতিরোধকে কেন্দ্র করেই এই নামকরণ।
সেনাবাহিনীর এক সময়ের কঠোর সমালোচক ইমরান খানও এবার সুর নরম করেছেন। জেল থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, জনগণের মনোবলই সেনাবাহিনীর শক্তি। যদিও তিনি বিচার ব্যবস্থার সংস্কারের ওপর জোর দিয়েছেন, তবে সেনাবাহিনীর প্রতি প্রকাশ্য বিরোধিতা নেই বললেই চলে।
পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে সেনাবাহিনীর প্রতি সমর্থন দৃশ্যমান হলেও খাইবার পাখতুনখোয়া এবং বেলুচিস্তানে জনগণের মনোভাব এখনো মিশ্র। এই দুটি অঞ্চল ঐতিহাসিকভাবেই সেনাবাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দমনপীড়নের অভিযোগে সংবেদনশীল। ফলে পুরো পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি পুরোপুরি পুনঃপ্রতিষ্ঠা পেয়েছে- এমনটা বলা কঠিন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারতের এই আগ্রাসী কৌশল অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে দিয়েছে এক বড় রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক সুবিধা। যুদ্ধের উত্তেজনা এবং জাতীয়তাবাদী আবেগ সেনাবাহিনীর জন্য সৃষ্টি করেছে ‘ঐক্যবদ্ধ হওয়ার’ বিরল পরিবেশ।
লন্ডনভিত্তিক বিশ্লেষক মারিয়া রাশিদ বলেন, আমরা সীমান্তে বাহিনীর সাফল্যকে স্বীকৃতি দিতে পারি, কিন্তু অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাদের হস্তক্ষেপকে চ্যালেঞ্জ জানাতেই হবে। তার মতে, জাতীয়তাবাদ এক সময়ের জন্য আবেগ তৈরি করে, কিন্তু টেকসই সমর্থন নির্ভর করে অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার ওপর।
এই সমর্থন কতদিন টিকবে? তার উত্তর এখনো অজানা। এটি নির্ভর করছে ভারতের পরবর্তী কৌশল, ইমরান খানের পিটিআইয়ের আন্দোলনের ধরন এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে- পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় সরকারের সক্ষমতার ওপর।
তবে আপাতত যেটি স্পষ্ট, তা হলো- ভারতের হামলা শুধু সীমান্তে ক্ষেপণাস্ত্র পাঠায়নি, বরং সেনাবাহিনীর ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’-এ একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারত হয়তো একবারে জিততে পারেনি, কিন্তু দেশটির সেনাবাহিনীর জন্য ভারত সবচেয়ে বড় ‘সহায়ক শক্তি’-তে পরিণত হয়েছে- একেবারেই অপ্রত্যাশিতভাবে।
আল জাজিরায় ইসলামাবাদের প্রতিনিধি আবিদ হোসাইনের কলাম, অনুবাদ : উমর শরীফ সোহাগ
মন্তব্য করুন