বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনায় দুটি হাত হারিয়ে ফেলেন ইব্রাহিম। অন্যদিকে তার দুই পা-ই অবশ। চিকিৎসার খরচ পল্লী বিদ্যুৎ নিলেও নেয়নি তার ভবিষ্যৎ জীবনের দায়িত্ব। তারপরও হাল ছাড়েননি তিনি। তাই নিজেকে আবারও কর্মব্যস্ত করে তোলার জন্য নিজ চেষ্টায় ছবি আঁকা শেখেন। এরপর শুরু হয় হুইল চেয়ারে বসে ছবি আঁকার ব্যস্ততা। মুখে তুলি। ঘাড় ঘুরিয়ে বারবার রং নিচ্ছেন আর একের পর এক নানা ছবি এঁকে চলেছেন। আর সে ছবি বিক্রির টাকায় নিজের চিকিৎসা ও সংসারের খরচ জোগাচ্ছেন ইব্রাহিম।
ইব্রাহিম মল্লিক নওগাঁর মান্দা উপজেলার পরানপুর ইউনিয়নের চককেশব গ্রামের মৃত নজর মল্লিকের ছেলে। বিধবা মা সুফিয়া বেগম, ভাই শহিদুল মল্লিক ও ভাবি সুলতানা মল্লিককে নিয়ে তার সংসার। পড়াশোনা করেছেন এইচএসসি পর্যন্ত। তিনি চাকরি করতেন দিনাজপুর পল্লী বিদ্যুতের লাইনম্যান হিসেবে।
স্থানীয় এলাকাবাসী জানায়, ইব্রাহিম ভালোবাসেন গ্রাম বাংলা ও প্রকৃতির ছবি আঁকতে। কখনো ফুল, ফল, প্রাণিকুল আবার কখনো গুণী মানুষদের ছবি আঁকেন। তবে উপজেলাভিত্তিক এই ছবিগুলোর প্রদর্শনীর ব্যবস্থা না থাকায় ইব্রাহিম তার প্রতিভা বিকাশের পর্যাপ্ত সুযোগ পাচ্ছে না। যদি তিনি বড় পর্যায়ে কখনো তার প্রতিভা দেখানোর সুযোগ পান তবে তিনি একদিন দেশের সম্পদ হয়ে উঠবেন
এমদাদুল মল্লিক ইব্রাহিম জানান, ২০০৫ সালে দিনাজপুরে পল্লী বিদ্যুতের লাইনম্যান হিসেবে কাজ করার সময় দুর্ঘটনার কবলে পড়েন তিনি। দুর্ঘটনার পর দিনাজপুর সদর হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সাভারের সিআরপিতে চিকিৎসা নেন ৮ বছর। কিন্তু চিকিৎসায় পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি তিনি। শরীর থেকে কেটে ফেলতে হয় দুই হাত। পা দুটি কাটা না লাগলেও হয়ে যায় অচল। তবে এসব প্রতিবন্ধকতা দমিয়ে রাখতে পারেনি ইব্রাহিমের প্রতিভাকে।
মুখ দিয়ে ছবি আঁকা প্রসঙ্গে ইব্রাহিম বলেন, সিআরপিতে থাকা অবস্থায় সবার কাছে শুনেছেন লাভলী নামে একজন মুখ দিয়ে ছবি আঁকতেন। লাভলীর সঙ্গে তার কখনো দেখা হয়নি। লাভলীর গল্প শুনেই অনুপ্রেরণা। প্রথম দিকে ছবি আঁকতে বসলে মাথা ঘুরত। বমি করতাম। পরে সব ঠিক হয়ে যায়। এখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছবি আঁকতে পারি। বেশি ভালো লাগে প্রাকৃতিক দৃশ্য আঁকতে। তবে বর্তমানে বেশিক্ষণ ছবি আঁকতে পারি না। একটানা ছবি আঁকলে গায়ে জ্বর আসে। শরীরের সার্বিক পরিস্থিতিও খুব একটা ভালো নেই। বর্তমানে তিনি নিজ বাড়ির পুকুরপাড়ে বসে মুখের সাহায্যে পেন্সিল ও রং-তুলি দিয়ে ছবি আঁকেন। তবে ছবির দাম নিয়ে দেন-দরবার তেমন একটা করা হয় না। বেশির ভাগ সময়ই একেকজন খুশি হয়ে যা দেন, তাই নেন।
তিনি আরও জানান, তিনি এখন মরা লাশ ছাড়া আর কিছুই নন। তার শরীরের খুব সামান্য একটা অংশ সচল। দৈনন্দিন কাজ ও ছবি আঁকাতে সহযোগিতা করেন অসুস্থ মা, বড়ভাই ও ভাবি। জন্মের আড়াই বছর বয়সে তার বাবা মারা গেছেন। মা আছেন বলেই পরিবারের অন্য সদস্যরা খুব একটা খারাপ ব্যবহার করেন না। গ্রামের মানুষরাও তাকে খুব ভালোবাসে। তবে মায়ের অবর্তমানে কী হবে এই চিন্তার কোনো কূলকিনারা খুঁজে পান না এই শিল্পী।
মান্দা পরানপুর ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মো. আতাউর রহমান জানান, বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনায় ইব্রাহিমের দুই হাত কেটে ফেলা হয়। অন্যদিকে তার দুই পা অচল। তারপরও সে হাল ছাড়েননি। নিজ চেষ্টায় মুখ দিয়ে ছবি আঁকেন। এতে ইব্রাহিমকে নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি। উপজেলা প্রশাসন থেকে ইব্রাহিমের জন্য সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দেন তিনি।
এ বিষয়ে মান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ আলম মিয়া জানান, মাউথ পেইন্টার ইব্রাহিম বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনায় দুই হাত হারিয়ে ফেলে। এরপর শখের বসে নয় জীবিকার তাগিদে মুখ দিয়ে ছবি আঁকা শিখেন। সেই ছবি বিক্রির টাকায় তার চিকিৎসা ও সংসারের খরচ জোগাচ্ছেন ইব্রাহিম। আমরা ইতোমধ্যে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছি। তারপরও আমরা অতি শিগগিরই তার জন্য উদ্যোগ নেব। ইব্রাহিমের যতগুলো ছবি আঁকা রয়েছে সেগুলো নিয়ে একক প্রদর্শনী করা হবে, যাতে এর মাধ্যমে ইব্রাহিমের মুখ দিয়ে ছবি আঁকা বিষয়ে জনগণ জানতে পারে।
মন্তব্য করুন