

এই উপমহাদেশে ধর্ম ও সংস্কৃতির মেলবন্ধনে গড়া যে কয়েকটি উৎসব সর্বজনীন জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, তার মধ্যে শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা একটি বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। ভারতের পুরীর গগনচুম্বী মন্দির থেকে দেবতাদের বিশাল কাঠের রথে চড়ে মানুষের মাঝে এসে ভক্তিস্নানে স্নাত হওয়া যেন আত্মিক অভ্যুদয়ের এক মহোৎসব। এ রথযাত্রা কেবল এক ধর্মীয় আচার নয়, বরং ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ (বিশ্বের সবাই আমাদের আত্মীয়) এ ধারণার বাস্তব অনুসরণ। ভগবৎ চেতনার এক ঐতিহাসিক প্রবাহ। ধর্ম নয় শুধু, সংস্কৃতি নয় শুধু, এ এক আত্মার অভিযাত্রা—রথের রশিতে বাঁধা মানুষের হৃদয়।
জগন্নাথ হলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এক বিশেষ রূপ। ‘জগন্নাথ’ শব্দের অর্থ ‘জগতের নাথ’ বা ‘বিশ্বের ঈশ্বর’। তিনি তার ভাই বলরাম ও বোন সুভদ্রাকে সঙ্গে নিয়ে পুরীর বিখ্যাত মন্দিরে পূজিত হন। এই তিনটি বিগ্রহ কাঠের তৈরি এবং তাদের নির্মাণ ও পূজাসংক্রান্ত রীতিনীতি প্রচলিত প্রথা থেকে খানিকটা ভিন্ন।
রথযাত্রার মূল ধারণা এটাই যে, ঈশ্বর নিজে ভক্তদের কাছে আসেন। যেমন গীতায় বলা হয়েছে—‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত...’ অর্থাৎ, যখনই ধর্মের অবক্ষয় ঘটে, তখন ঈশ্বর অবতাররূপ ধারণ করে মানুষকে উদ্ধার করতে আসেন। রথযাত্রা সেই আগমনের প্রতীক। বাসুদেব সর্বমিতি (ঈশ্বর সবকিছু জানেন বা নিয়ন্ত্রণ করেন) এই আপ্তশ্লোক অনুসরণ করে ভগবৎ আশীর্বাণী লাভের জন্য নিজেকে নিবেদন করার বেদিমূল এই রথযাত্রা। পুরাণ অনুসারে, দ্বারকারাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন এক রাতে স্বপ্নে আদেশ পান একটি বিশিষ্ট কাঠের বিগ্রহ নির্মাণ করে পূজা করার। সেই আদেশ অনুযায়ী নির্মিত হয় জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার কাঠের বিগ্রহ। মজার বিষয় হলো, এ বিগ্রহদের হাতে-পা নেই, মুখ অসম্পূর্ণ; যা ঈশ্বরের রহস্যময়
রূপকে বোঝায়। প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে দেবতারা তিনটি বিশাল রথে চড়ে গুন্ডিচা মন্দিরে গমন করেন, যেখানে তারা এক সপ্তাহ অবস্থান করেন। তারপর উল্টো রথযাত্রায় তারা ফিরে আসেন।
রথযাত্রা শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি দর্শনেরও উৎস। এ উৎসব মনে করিয়ে দেয়—ঈশ্বর স্থির নন, তিনি চলমান, তিনি মানুষের সঙ্গে পথচলার প্রতীক। এ চলার মধ্যেই জীবনের অর্থ। তিনি দূরে নন, কাছে আছেন। রশির একপ্রান্তে তিনি এবং অন্যপ্রান্তে মানুষ। যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত। ভগবানের আরাধনা করলে নিজের মনের কথা ভগবাঙ্কে জানানো সম্ভব।
জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা সনাতন ধর্মের বহুত্ববাদী চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। এতে জাত, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা নির্বিশেষে সবাই অংশগ্রহণ করতে পারেন। দেবতারা যখন মন্দিরের চার দেয়াল পেরিয়ে রথে চড়েন, তখন তা বোঝায় ঈশ্বর নিজে মানুষের মধ্যে মিশে যেতে চান। এ উৎসবে শুধু সনাতন ধর্মচারীরা নয়, বহু বিদেশি পর্যটক এবং অন্য ধর্মাবলম্বীরাও যোগ দেন। পারিবারিক সম্পর্ক যে অত্যন্ত গুরুত্ববহ তাও রথযাত্রায় প্রতিষ্ঠিত। শ্রুতিমতে, রথ মাসির বাড়ি আসে। এখানে অবস্থান শেষে আবার তারা নিজ আলয়ে ফিরে যান। সামাজিক সম্পর্কের এ বাস্তব চর্চা রথযাত্রার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
রথযাত্রা সমাজে ভ্রাতৃত্ববোধ, সাম্য ও সৌহার্দ্য বৃদ্ধি করে। এটি শুধু ভক্তির উৎসব নয়, বরং এক বৃহৎ সামাজিক মিলনমেলা।
যুগ যুগ ধরে এ উৎসব প্রমাণ করে এসেছে যে, ঈশ্বর শুধু মন্দিরে সীমাবদ্ধ নন, তিনি মানুষের হৃদয়ে, মানুষের ভিড়ে, চলার পথে। রথের রশিতে টান দিতে দিতে মানুষ যেন নিজের অন্তরের রথকেও চালনা করে—আলো থেকে আরও আলোর দিকে। জয় জগন্নাথ।
লেখক: ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির কমিটির উপদেষ্টা পুরোহিত; সম্পাদক জয় বাবা লোকনাথ পঞ্জিকা এবং অতিরিক্ত সচিব (অব.)
মন্তব্য করুন