সব প্রজন্মেই দেখতে পাওয়া যায়, আমাদের প্রজন্মেও দেখেছি, আমার কন্যাদের সময়েও সেটা চলে এসেছে, বর্তমান সময়েও এর ব্যত্যয় ঘটেনি এবং সমাজ ও দেশভেদেও এর পরিবর্তন হয়নি। সব দেশে, সব প্রজন্মেই বয়স্করা বলেছেন যে, তরুণরা অস্থিরমতি, হঠকারী ও প্রগলভ। তারা শুধু সবকিছু ভাঙতে চায়, বদলাতে চায় সামাজিক বিধিবিধান, রীতিনীতি, ফ্যাশন, দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্বাস, স্থিতিশীলতা। তারা দমকা হাওয়ার মতো সবকিছু উড়িয়ে নিতে চায়।
অন্যদিকে, তরুণেরা বলে বিশ্ব দ্রুত বদলাচ্ছে। বদলাচ্ছে সমাজ কাঠামো, সামাজিক রীতিনীতি, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ। ভাষা ও আচার-ব্যবহারও বদলে যাচ্ছে। এ বদলে যাওয়া পৃথিবীর জন্য পুরোনো ঘুণে ধরা ব্যবস্থা আর কাজ করছে না, তাই প্রথাগত কাঠামোর খোলনোলচে বদলাতে হবে। তরুণদের কথায়, বিবর্তনের মাধ্যমে এ পরিবর্তন আসবে না; এ বদলের জন্য লাগবে বিপ্লব। প্রথাগত ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়ার সীমাবদ্ধতা দেখতে পারে বলেই কাঠামো বদলের জন্য তরুণদের এমন আকুলতা ও ব্যাকুলতা।
সমাজ পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় তরুণরা প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে কয়েকটি বিশেষ কারণে। প্রথমত, তাদের প্রাণশক্তি। সমাজ পরিবর্তনের জন্য যে জীবনীশক্তি প্রয়োজন, তার প্রধান উৎস হচ্ছে তরুণ সমাজ। দ্বিতীয়ত, তরুণদের উদ্দামতা এবং প্রাণ-উন্মাদনা। সন্তর্পণ ও সতর্ক হিসাব-নিকাশ করে সবসময় সমাজ পরিবর্তন ঘটানো যায় না। অনেক সময় সেখানে প্রয়োজন হয় বেহিসেবি ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো কিছু। কোনো পরিবর্তনই ঝুঁকিমুক্ত নয়। তরুণদেরই ঝুঁকি নেওয়ার স্বাভাবিক প্রবণতা রয়েছে। তৃতীয়ত, ভিন্নভাবে প্রথাগত চিন্তা-চেতনার বাইরে গিয়ে নতুন এবং অপ্রথাগত চিন্তা করার সক্ষমতার বিরল ক্ষমতা তরুণদেরই আছে। এখান থেকেই আসে তাদের সৃষ্টিশীলতা এবং সৃজনশীলতা—সমাজ পরিবর্তনের জন্য যা অপরিহার্য। চতুর্থত, তরুণদের সাহস ও মনোবল। যে কোনো সমাজ পরিবর্তনে সাহস ও মনোবল অত্যন্ত জরুরি। তরুণরা হচ্ছে সেই কাঙ্ক্ষিত সাহস এবং মনোবলের মূল আধার। পঞ্চমত, তরুণসমাজ অতিদ্রুত নিজেদের সংগঠিত করতে পারে, যা সবরকমের পরিবর্তনের জন্য অপরিহার্য।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তরুণদের শক্তি কী করে সমাজ, রাষ্ট্র এবং পৃথিবী বদলে দিয়েছে যুগে-যুগে, দেশে-দেশে। না, ইতিহাসের দ্বারস্থ হচ্ছি না আমি এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য। আমি বরং আমার পড়া, আমার শোনা এবং আমার দেখা ঘটনার উল্লেখ করি আমার যুক্তির সপক্ষে। ছোটবেলায় ভারতের মুক্তিসংগ্রামে তরুণদের আত্মাহুতি দেওয়ার অনেক গল্প পড়েছিলাম—ক্ষুদিরাম ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে গিয়েছিলেন; সুনীতি চৌধুরী ও শান্তি ঘোষ কুমিল্লায় ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে হত্যা করেছিলেন; সত্যেন বসু ও কানাইলাল দত্ত সম্পৃক্ত ছিলেন আলীপুর বোমা মামলায়। এসব তরুণই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এক বিশাল শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। রাষ্ট্র পরিবর্তনের সংগ্রামে তরুণদের শক্তির সঙ্গে কিশোর আমার সেই প্রথম পরিচয়। বুঝেছিলাম যে, তরুণদের সাহস, মনোবল ও শক্তির কাছে ক্ষমতাধর প্রতিপক্ষও দাঁড়াতে পারে না।
সময়টা ১৯৭০। ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। সারা বিশ্বের তরুণরা তখন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত। নানান দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা আন্দোলন করছে, পতাকা পোড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের। যুক্তরাষ্ট্রের ছাত্রসমাজও সোচ্চার ভিয়েতনামে তাদের সরকারের অংশগ্রহণ ও গৃহীত নীতির বিরুদ্ধে। দিনটি মে ৪। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্ট স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়। স্লোগানমুখর সব বিশ্ববিদ্যালয় ভিয়েতনাম যুদ্ধকে কম্বোডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়ার মার্কিনি হীন চক্রান্তে। সেদিন কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচণ্ড উত্তেজনা, ন্যাশনাল গার্ডদের নিয়ে আসা হয়েছে অবস্থা আয়ত্তে আনার জন্য। হঠাৎ গুলির শব্দ। মাটিতে লুটিয়ে পড়ল জেফরি মিলার। তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল জেফরির বন্ধু মেরি অ্যান ভেক্কিও। দুই হাত মেলে কী এক আর্ত, অসহায় কিন্তু দ্রোহের ভঙ্গি তার! সেই ছবি প্রতীকী হয়ে রইল সারা পৃথিবীর ইতিহাসে তারুণ্যের প্রতিবাদের। ঘটনাটি যুক্তরাষ্ট্রের ভিয়েতনাম বিষয়ে অবস্থানের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। কলাম্বিয়া ও বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয় রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। তরুণরা ভিয়েতনামে মার্কিন নীতির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলে। দুই বছরের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনাম থেকে বেরিয়ে আসে।
সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বের ছাত্রসমাজের এই যে লড়াই ও বিজয়, তা তারুণ্যের বিশাল শক্তিরই পরিচায়ক। এ শক্তি শুধু আন্দোলনের শক্তি ছিল না, নিজেদের দলবদ্ধ করার শক্তি ছিল না; এটা ছিল বিশাল এক নৈতিক শক্তি ও নৈতিক বিজয়। তারুণ্যের এ বিজয় দুটো সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল—এক. পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় অন্যায় দেখলে তরুণরা তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে এবং ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেবে। দুই. তারুণ্যের শক্তির কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শক্তিও মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়।
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে তারুণ্যের শক্তির পরিচয় আমরা পেয়েছি। আমাদের মুক্তিসংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে গেছে ছাত্রসমাজ। ১৯৬৯-এর গণআন্দোলন থেকে ১৯৭১-এর মুক্তিসংগ্রামে আমাদের তরুণ ছাত্রসমাজের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। তারা এগিয়ে নিয়ে গেছে রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে। তারা প্রমাণ করেছে যে, ‘বাংলাদেশের তরুণসমাজ আজ যা ভাবে, বাংলাদেশ তা আগামীকাল ভাবে।’ একটি অঙ্গীকার নিয়ে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা আর উন্মাদনা নিয়ে ৭১-এ তরুণসমাজ ঘর ছেড়ে যুদ্ধে গিয়েছিল। ৯ মাসের একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রর জন্ম হয়। বাংলাদেশ তরুণদের একটি স্বপ্নের, একটি আকাঙ্ক্ষার ফসল। সে পথযাত্রায় আমার প্রজন্ম এবং আমিও ছিলাম।
সে পথযাত্রার মূল কথা ছিল শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয়, জনগণের মুক্তিও। সে মুক্তি আকাঙ্ক্ষার ব্যাপ্তি ছিল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও। স্বাধীনতার প্রায় আড়াই দশক পর দেখা গেল যে, সময় বয়ে গেছে, কিন্তু জনগণের মুক্তি আসেনি। আবার ছাত্রদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে আন্দোলন। তাদের দমনের জন্য তাদের ওপর ট্রাক তুলে দেয় শাসককুল। গুলিতে মারা যায় কত তাজা প্রাণ। জন্ম নেয় সেই অবিস্মরণীয় শব্দগুচ্ছে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। গণতন্ত্রকে মুক্তি দেওয়ার জন্য তরুণসমাজ গড়ে তোলে এক গণঅভ্যুত্থানের পটভূমি। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের ফলে ক্ষমতার পটপরিবর্তন ঘটে।
সেই গণঅভ্যুত্থানেও অগ্রণী ভূমিকা ছিল তরুণদের—পরিবর্তনের দাবিতে, জনগণের মুক্তির দাবিতে। পরিবর্তন ঘটানোর ক্ষেত্রে তাদের শক্তির পরিচয় আবারও পরিস্ফুট হয়ে উঠেছিল সবার কাছে। তারপর অনেক সময় পেরিয়ে গেছে, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসেনি, আসেনি জনগণের মুক্তি এবং গণতন্ত্রের মুক্তি। বরং অন্যায়, অবিচারতার, স্বেচ্ছাচারিতা জেঁকে বসেছে পুরো কাঠামোতে, যেখানে জনগণ অধিকার হারিয়েছে, সুবিচার পায়নি। অন্যদিকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকবৈষম্যের একটি সুবিধাভাগী গোষ্ঠী শুধু সম্পদের পাহাড়ই গড়ে তোলেনি, সেসব সম্পদ নিরাপদে পাচার করেছে বাইরে। জনঅসন্তোষ, জনউৎপীড়ন জন্ম দিয়েছে একটি গণতান্ত্রিক বৈষম্যহীন সমাজ আকাঙ্ক্ষার, যার জন্য ছাত্র-জনতা আবার নেমেছিল সংগ্রামে।
গত বছর গণঅভ্যুত্থান তাই আমাদের সংগ্রাম পরম্পরা ধরেই এসেছে। ছাত্র-জনতার এ আন্দোলনে আবারও তারুণ্যের শক্তি উদ্ভাসিত হয়েছে। তারুণ্য আজ শুধু পরিবর্তনের সংগ্রামরত নয়, পরিবর্তন ঘটানোর সক্ষমতায় স্থিত। আজ তাই তারুণ্যের শক্তি নবতর মাত্রিকতা লাভ করেছে। আমরা সবাই চেয়ে আছি, কোন পথে সে যায়।
মন্তব্য করুন