বাংলাদেশের রাজনীতির এক চরম সংকটময় মুহূর্তে যখন বাকশালী একনায়কতন্ত্রের অবসানের পরও এ দেশের রাজনীতি কোনো সঠিক লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারছিল না, সরকারের অনুমোদনপ্রাপ্ত রাজনৈতিক দলগুলো ভেতরে-বাইরে ক্রমাগত কোন্দলের কারণে ভেঙে খানখান হচ্ছিল, তখনই শহীদ জিয়া এলেন, রাজনীতির বদ্ধঘরে সূর্যের আলো ছড়াতে, তারই নেতৃত্বে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি।
জাতীয়তাবাদী দল গঠনের সঙ্গে সঙ্গে দেশের সব অনিশ্চয়তার কালো মেঘ দূরীভূত হয়। জাতি প্রভাত দিনের রাঙা আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
শহীদ জিয়ার প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ঘোষণাপত্রের শুরুতে এ কথাগুলো লেখা আছে—ঐতিহাসিক মুক্তিসংগ্রামের সোনালি ফসল, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব আমাদের পবিত্র আমানত এবং অলঙ্ঘনীয় অধিকার। প্রাণের চেয়ে প্রিয় মাতৃভূমির এ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুদৃঢ় ও সুরক্ষিত করে রাখাই হচ্ছে আমাদের কালের প্রথম ও প্রধান দাবি। বিবর্তনশীল ইতিহাস এবং সাম্প্রতিক জীবনলব্ধ অভিজ্ঞতা আমাদের এ শিক্ষাই দেয় যে, ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত গণপ্রচেষ্টা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের কালজয়ী রক্ষাকবচ। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অতন্দ্র প্রহরী হচ্ছে যথাক্রমে—
১. বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে অনুপ্রাণিত ও সংহত ইস্পাতকঠিন গণঐক্য; ২. জনগণভিত্তিক গণতন্ত্র ও রাজনীতি এবং ৩. ঐক্যবদ্ধ ও সুসংগঠিত জনগণের অক্লান্ত প্রয়াসের ফলে লব্ধ জাতীয় অর্থনৈতিক মুক্তি—আত্মনির্ভরশীলতা ও প্রগতি।
সুদৃঢ় ও অভেদ্য জাতীয় ঐক্যবোধ এবং জাতীয় অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা না থাকলে সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ ও নয়া উপনিবেশবাদের গ্রাস থেকে জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা রক্ষা করা দুঃসাধ্য। জাতীয় ঐক্যের অভাব, বিশেষত দেশপ্রেমিক শক্তি ও গোষ্ঠীর মধ্যে সমঝোতা ও মৌলিক ঐক্যবোধের অভাব বাংলাদেশের মতো আপাত দরিদ্র অথচ উন্নয়নশীল রাষ্ট্র সহজেই বৈদেশিক আধিপত্যবাদ এবং অভ্যন্তরীণ বিধ্বংসী প্রক্রিয়ার শিকারে পরিণত হতে পারে। কয়েক বছর আগের ইতিহাস এই বিশ্লেষণের সত্যতাকে প্রমাণ করেছে। আমাদের জাতীয় অনৈক্য ও বিভেদের সুযোগ নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী, নয়া উপনিবেশবাদী ও সম্প্রসারণবাদী শক্তিগুলো বাংলাদেশের উন্নতি ও প্রগতির পথ রুদ্ধ করেই ক্ষান্ত হয়নি, অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতার মাধ্যমে আমাদের জাতিকে বিভ্রান্ত, নিরুৎসাহ ও পশ্চাদ্গামী করারও প্রয়াস পেয়েছে। এসব অশুভ শক্তির তৎপরতার ফলে আমাদের সার্বভৌমত্ব খর্ব হয়ে পড়েছিল, কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদন হয়েছিল মারাত্মকভাবে ব্যাহত, রাজনীতি হয়েছিল বিদেশি প্রভুদের সেবাদাস, পররাষ্ট্রনীতিতে এসেছিল দাসসুলভ স্থবিরতা, সমাজ জীবনে নেমে এসেছিল মূল্যবোধের চরম সংকট এবং সর্বগ্রাসী বিভ্রান্তি, শিক্ষাঙ্গনে হামলা চালিয়ে সৃষ্টি করেছিল অপরিসীম নৈরাজ্য। এককথায় বাংলাদেশি জাতির স্বাধীন, সার্বভৌম সভ্য অস্তিত্ব হয়েছিল মহাবিপর্যয়ের সম্মুখীন। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের ঐক্যবদ্ধ জাতীয় বিপ্লব এ ভয়াবহ প্রক্রিয়ার
অবসান ঘটিয়ে যে নতুন ঊষার আহ্বান জানায়, গত কয়েক বছরের অধিককালের পরিসরে তার বলিষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে ১৯৭৮-এর ৩ জুনের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, প্রাপ্তবয়স্ক বাংলাদেশি নাগরিকের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হওয়ার ফলে জাতীয়ভিত্তিক ঐক্যের ইতিবাচক দিকটি আমাদের জনজীবনে প্রাসঙ্গিকভাবে সংঘবদ্ধ হয়েছে।
বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী দল গঠনের মধ্যে আমাদের ভাষা, কৃষ্টি, ধর্ম, ইতিহাস, ঐতিহ্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় মূল্যবোধ, শোষণমুক্ত প্রগতিশীল সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। আমাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষা, জাতীয় সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য প্রভৃতি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী দলের ভেতরে পরিপূর্ণতা লাভ করছে। তাই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের চেতনা বুকে ধারণ করেই সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে যেতে হবে। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের দর্শন এবং চেতনা থেকে এ দেশের জনগণকে নিজেদের সত্তা রক্ষা এবং দেশের প্রতি ইঞ্চি জমি রক্ষা করার ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে।
শহীদ জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের জন্য ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল’ গড়ে তোলেন। একই সঙ্গে জাতীয়তাবাদী দর্শনের ওপর এটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও চালু করেন। এসবের ফলে রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণায় ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ একটি অধ্যায় অতিক্রম করে। কিন্তু যেহেতু এই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশের স্বোপার্জিত সাংস্কৃতিক সোসিয়ো-পলিটিক্যাল এবং জিয়ো-পলিটিক্যাল স্বাতন্ত্র্যিক ধারার একটি বাস্তবসংগত উত্তরাধিকার, সেহেতু শুধু রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার না করে সামগ্রিক জাতিসত্তার বিচারে এর একটি রাষ্ট্রনৈতিক রূপরেখা পরিষ্কার থাকা দরকার এবং সেইসঙ্গে জাতীয়তাবাদী চিন্তা-চেতনালোকের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
আজকের এ বিভ্রান্তিকর রাজনৈতিক সংকটে যদি আমরা শহীদ জিয়ার দর্শনকে চেতনায় ও মননে ধারণ করতে পারি, যখন রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে অগণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও বিদেশি প্রভুদের নেতৃত্ব প্রকট, তখন স্বাদেশিক মূল্যবোধ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির জাগরণ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। আমরা যদি শহীদ জিয়ার আদর্শ ও স্বপ্নকে লালন ও প্রতিপালনে অগ্রসর হই, তবে অস্থিরতার হাত থেকে দেশের গণতন্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হবে। আসুন আমরা শহীদ জিয়ার পছন্দের সেই গানটি আবার গেয়ে উঠি—
প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ
জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ।
লেখক: সহপ্রচার সম্পাদক, বিএনপি
মন্তব্য করুন