মফস্বল সাংবাদিকতার এক উজ্জ্বল নক্ষত্র গৌতম দাসের ৫২তম জন্মবার্ষিকী আজ। ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার চন্দ্রীদাসদী গ্রামে ১৯৭২ সালের ১৮ মে জন্মগ্রহণ করেন। সাংবাদিক গৌতম দাস সারা দেশ ও সংবাদমাধ্যমকে আলোকিত করতে জীবন দিয়েছেন, কর্মের প্রতি তার এই বস্তুনিষ্ঠতা আর গণমাধ্যমের নৈতিক শক্তির সক্ষমতা নিজের জীবনের বিনিময়ে প্রমাণ করে গেছেন।
ফরিদপুর জেলায় গণমাধ্যমের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার যোদ্ধা সাংবাদিক গৌতম দাস। স্কুলে পড়া অবস্থায় ছাত্রদের বেতন ও পরীক্ষার ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে সোচ্চার হন তিনি।
তিনি ভাঙ্গা কাজী মাহবুল্লাহ কলেজ শাখার ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি থাকা অবস্থায় সাপ্তাহিক একতা পত্রিকার মাধ্যমে সাংবাদিকতা পেশায় যাত্রা শুরু করেছিলেন। এরপর স্থানীয় অনেকগুলো পত্রিকা ও জাতীয় পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। তিনি প্রথম আলো ও সমকাল পত্রিকায় ফরিদপুর জেলা প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করেন। মৃত্যুর আগে তিনি সমকালের ফরিদপুর ব্যুরো প্রধানের দায়িত্ব পালন করছিলেন। তার সাংবাদিকতা ছিল মফস্বল সাংবাদিকদের জন্য আদর্শ। অন্যায় অনিয়মের বিরুদ্ধে লিখে ফরিদপুর জেলায় সাংবাদিকদের মধ্যে অন্যতম হয়ে ওঠেন গৌতম দাস।
সাংবাদিকদের অন্যতম একজন আদর্শবান ব্যক্তিত্ব, সমাজের বিভিন্ন অসংগতি তুলে ধরা এবং মানুষের সেবায় ব্রত ছিলেন। সমকাল পত্রিকায় কাজ করা অবস্থায় ২০০৫ সালের ১৭ নভেম্বর ফরিদপুর শহরের নিলটুলী মুজিব সড়কে সরণি মার্কেটে দৈনিক সমকাল ব্যুরো অফিসে গৌতম দাসকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা।
ফরিদপুর শহরের প্রধান সড়ক মুজিব সড়কের সংস্কার কাজের অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে সংবাদ প্রকাশ করায় সাংবাদিকদের ওপর ক্ষুব্ধ হন তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মদদপুষ্ট ঠিকাদার গোষ্ঠী।
২০০৫ সালের ১৭ নভেম্বর সকালে ঠিকাদার আসিফ ইমরান ও ৯ সহযোগী মিলে শহরের জনতা ব্যাংকের মোড়ের কাছে সরণি সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় সমকাল অফিসে ঢুকে নির্যাতন ও শ্বাসরোধে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেন। ওই দিন সকাল ১১টার দিকে তার সহকর্মীরা সরণি সুপার মার্কেটের নিচে, যেখান থেকে সাংবাদিকরা নিউজ ফ্যাক্স করতেন, সেই দোকানে সমবেত হন। সেখানে গৌতমকে না দেখে তার মোবাইলে ফোন করা হয়। মোবাইল বন্ধ পাওয়ায় ধারণা করা হয়, হয়তো সে রাত জেগেছে, তাই ঘুমাচ্ছে।
তার মৃত্যুর খবর তখনও কেউ জানেন না। দুপুর ১২টার দিকে সমকালের তখনকার ফরিদপুর প্রতিনিধি হাসানউজ্জামান সমকাল অফিসে গৌতমকে ডাকতে যান। কিন্তু অনেকক্ষণ তার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে সহকর্মী নির্মলেন্দু চক্রবর্তী শংকরকে নিয়ে পাশে নির্মাণাধীন ভবনের ছাদ থেকে সমকাল অফিসের জানালা দিয়ে গৌতমকে খোঁজার চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা যা দেখেন তা মর্মান্তিক, যা তাদের ভাবনায়ও ছিল না। যে ব্যানার নিয়ে মুজিব সড়কের সংস্কারকাজের দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানববন্ধন করা হয়েছিল, সেই ব্যানারের পাশেই পড়ে ছিল গৌতমের নিষ্প্রাণ দেহ, মুখে নির্যাতনের তীব্র যন্ত্রণার ছাপ, গলায় পেঁচানো নাইলনের এক টুকরো রশি।
দুপুরে পুলিশ দরজা ভেঙে তার লাশ উদ্ধারের পর হাজার হাজার জনতার ঢল নামে গৌতমের লাশ দেখতে। নিরীহ, সহজ-সরল ছেলেটি কারও শত্রু হতে পারে, তা ছিল সবার ধারণার বাইরে। কিন্তু তার সহজাত সারল্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ব্যক্তিত্ব ও সত্য প্রকাশের অদম্য সাহস তার অজান্তেই যে কায়েমি স্বার্থের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তা যেমন বুঝতে পারেনি মানুষ, যেমনটি বোঝেননি গৌতম নিজেও।
তার অকালমৃত্যু নাড়া দিয়েছিল সর্বস্তরের ফরিদপুরবাসীসহ সারা দেশের সাংবাদিক সমাজকে। সেদিন থেকেই ফরিদপুরসহ সারা দেশে বিক্ষুব্ধ সাংবাদিক সমাজ ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন শুরু করে। ফরিদপুরে কর্মরত সাংবাদিকদের ব্যানারে চলে লাগাতার আন্দোলন।
এ আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম্য হয়ে মাঠে নামেন ফরিদপুরের মুক্তিযোদ্ধা, আইনজীবী, নারী সংগঠন, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। এরই ফলে পুলিশ মাত্র দুই মাসের মাথায় বেশির ভাগ আসামিকে গ্রেপ্তার করে এবং মামলার চার্জশিট দেয়। তৎকালীন সরকার বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে মামলাটি চাঞ্চল্যকর বিবেচনা করে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে প্রেরণ করে।
২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি সাংবাদিক গৌতম দাস হত্যা মামলায় নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত পাঁচজন আসামিকে যাবজ্জীবন হাইকোর্টের রায়ে বহাল রেখেছে এবং চারজনকে খালাস দিয়েছে হাইকোর্ট। বিচারপতি এ কে এম আবদুল হাকিম ও বিচারপতি ফাতেমা নজীবের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দিয়েছিল।
মন্তব্য করুন