কোরবানির ঈদের বাকি আর মাত্র ৪ দিন। কিন্তু এর আগেই বড়সড় এক ধাক্কা খেল দেশের ভোগ্যপণ্যের বৃহত্তম পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের অর্ধশত ব্যবসায়ী। প্রায় ৫০ কোটি টাকা পাওনা পরিশোধ না করেই উধাও প্রতারক এক ব্যবসায়ী। এতে বড় অংকের মূলধন হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন এসব ব্যবসায়ীরা।
তারা জানিয়েছেন, মসলাজাতীয় পণ্য এলাচ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ডেলিভারি অর্ডার বা সংক্ষেপে ডিও বাণিজ্যের সুযোগে এই প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনায় ১১ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে ট্রেড অ্যাসোসিয়েশন। তবে এ নিয়ে ব্যাপক গুঞ্জন চললেও প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন না ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা।
শুধু খাতুনগঞ্জই নয়, বন্দর নগরীতে বেড়েছে ব্যবসায়ীর টাকা হাতিয়ে পালানোর আরও অনেক ঘটনা। তাই লেনদেনের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের আরও সচেতন হওয়ার তাগিদ সংশ্লিষ্টদের।
জানা যায়, গত কয়েক মাস ধরে অস্থির খাতুনগঞ্জে এলাচের বাজার। ডিও ব্যবসার নামে কাগজ বিক্রির মাধ্যমে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা হাত বদল হয়ে আসছিল গত কয়েক মাসে। এবার সেই এলাচের ডিও ব্যবসায় প্রতারণার ফাঁদে আটকালেন ব্যবসায়ীরা। খাতুনগঞ্জের সোনামিয়া মার্কেটের ব্যবসায়ী নূর ট্রেডিংয়ের মালিক নাজিম উদ্দিন ব্যবসায়ীদের অর্ধশত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। মূলত ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) বাণিজ্যের সুযোগে এ প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
খাতুনগঞ্জের ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা জানান, গত বুধবার (৫ জুন) অনেক ব্যবসায়ীর কাছে এলাচের ডিও বিক্রি করে টাকা নগদায়ন করে হঠাৎ মোবাইল বন্ধ করে দেন নাজিম। ওইদিন কমপক্ষে ৫ কোটি টাকার এলাচের ডিও বিক্রি করলেও তার বিপরীতে ক্রেতাদের পণ্য কিংবা টাকা দেননি নাজিম। শুধু তাই নয়, ঘটনার তিন-চার দিন আগে থেকে যেসব ব্যবসায়ীর কাছ থেকে তিনি পণ্য কিংবা ডিও কিনেছেন, তাদের টাকাও পরিশোধ করেননি নাজিম।
ব্যবসায়ীরা জানান, বুধবার সন্ধ্যায় বিষয়টি আলোচনায় আসার পর পাওনাদার ব্যবসায়ীরা নাজিমকে খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের অফিসে নিয়ে যান। ওই সময় কমপক্ষে ৪০-৫০ জন পাওনাদার তাদের পাওনার বিষয়ে অভিযোগ দেন অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের কাছে। ঘটনার সুরাহা না হওয়ায় ওই দিন রাতে তাকে সমিতির কার্যালয়ে আটকে রাখা হয়। পরদিন তার ভগ্নিপতি এসে সমিতির নামে ১০ কোটি টাকার চেক দিয়ে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক আলমগীর পারভেজ বলেন, সোনামিয়া মার্কেটের একজন ব্যবসায়ীর কাছে টাকা আটকে যাওয়ায় অভিযুক্ত ব্যবসায়ীকে নিয়ে প্রায় ৪০-৫০ জন ব্যবসায়ী গত বুধবার সমিতির কার্যালয়ে আসেন। যার কাছে প্রায় অর্ধশত কোটি আটকে যাওয়ার বিষয়ে অভিযোগ করেন ব্যবসায়ীরা। পাওনাদারদের পাওনা পরিশোধের আশ্বাসে অভিযুক্ত নাজিম উদ্দিনকে তার ভগ্নিপতির জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ছাড়া পাওয়ার পর থেকে গা ঢাকা দেন ওই ব্যবসায়ী। এই ঘটনায় ১১ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে।
ভুক্তভোগী তানিশা এন্টারপ্রাইজের আব্দুল মান্নান জানান, গত মঙ্গলবার নূর এন্টারপ্রাইজ থেকে তিনি ১১ টন এলাচের ডিও কিনেন। কিন্তু এর বিপরীতে এলাচ কিংবা চেক কোনোটাই দেননি নাজিম। আরও কয়েকজন ব্যবসায়ীর কাছে নাজিমের দেওয়া চেক পাস না হওয়ায় তার প্রতারণার বিষয়টি সামনে আসে। এরপর আমরা তাকে ব্যবসায়ী সমিতির অফিসে নিয়ে যাই। সমিতি থেকে পাওনা পরিশোধের সময় নিয়ে এখন তিনি বাজার থেকে উধাও হয়ে গেছেন।
ভুক্তভোগী শাহেদ এন্টারপ্রাইজের শাহেদুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকাই ছিল আমার সর্বস্ব। আমার আর কিছুই নেই। শুধু আমারই নয়, আরও ৬০ থেকে ৭০ জন মানুষের এমন টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে নাজিম।
তানিশা এন্টারপ্রাইজ ছাড়াও নাজিম উদ্দিনের কাছে শাহেদ এন্টারপ্রাইজের শাহেদুল ইসলাম ১৬ টন এলাচ বাবদ ৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা, আর এস ট্রেডিংয়ের সাজ্জাত চৌধুরীর ২ টন এলাচ বাবদ ৮০ লাখ ৮০ হাজার, এসকে ট্রেডার্সের কফিল উদ্দিনের ২০ টন এলাচ বাবদ সাড়ে আট কোটি টাকা, দীন কোম্পানির কামাল উদ্দিনের ৮৪ লাখ টাকা, মেহের স্টোরের মো. আলীর ৮০ লাখ টাকা এবং এএম ট্রেডার্সের মো. লিটনের এক কোটি টাকাসহ ৪০-৫০ জন ব্যবসায়ীর অর্ধশত কোটি টাকা পাওনা আটকে গেছে।
আর এস ট্রেডিংয়ের সাজ্জাত চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, অ্যাসোসিয়েশন বিষয়টির দায়িত্ব নিয়েছে। এরমধ্যে কেউ কেউ থানায় জিডিও করেছেন। আশা করি সংশ্লিষ্টদের তদারকিতে বিষয়টি সুন্দরভাবেই সমাধান হবে।
খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক জামাল হোসেন কালবেলাকে বলেন, আগে তেল, গম, চিনিতে ডিও ব্যবসা হতো। এখন তেল, চিনিতে সরকার দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার পর থেকে ডিও ব্যবসায়ীরা এলাচে বিনিয়োগ করছেন। এ সুযোগে অসাধু কিছু ব্যবসায়ী ডিও’র নামে শুধু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের স্লিপ ধরিয়ে দিয়ে প্রতিদিন শত শত টন এলাচ কেনাবেচা করছেন। ডিও যারা কেনাবেচা করছেন তাদের অনেকেই এসব এলাচের সত্যিকার মজুতের বিষয়েও জানেন না। পণ্যের চেয়ে টাকার বিনিয়োগ বেড়ে যাওয়ায় এলাচের ডিও ব্যবসা ‘জুয়া খেলায়’ রূপ নিয়েছে বলে মন্তব্য করেন ব্যবসায়ীরা। এসব ডিও ব্যবসার বৃহৎ অংশই নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছে সোনামিয়া মার্কেট থেকে।
খাতুনগঞ্জের মসলা ব্যবসায়ীরা জানান, ডিও ব্যবসায় যুক্ত হওয়ায় বর্তমানে বাজারে সবচেয়ে বেশি অস্থির এলাচের দাম। ডিও ব্যবসায় বর্তমানে ভালোমানের এলাচের চেয়ে মধ্যমমানের এলাচের দাম বেশি। আবার যারা বাজার থেকে এলাচ কিনছেন, একই এলাচ ট্রেডিংয়ের চেয়ে প্রতি কেজিতে ৮শ থেকে হাজার টাকা কম। এলাচের এ ব্যবসা ‘জুয়া’র মতো।
ডিও হলো পণ্য বিক্রির বিপরীতে দেওয়া ডেলিভারি অর্ডার। এলাচের ক্ষেত্রে ডিও ট্রেডিংয়ের মধ্যমে সঙ্গে সঙ্গে এলাচের ডেলিভারি না নিয়ে ভবিষ্যতে নেওয়ার জন্য মসলাটির কেনা-বেচার চুক্তি করা হয়। এর মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা স্বল্প সময়ে পণ্যটির মূল্য ওঠানামা থেকে মুনাফা অর্জনের লোভে প্রায়ই বড় অঙ্কের চুক্তিতে যান। তাদের এই কারসাজিতে অস্থির হয়ে ওঠে পণ্যের বাজার। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন ভোক্তা, ব্যবসায়ী উভয়ই।
খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী সেকান্দার হোসেন জনান, এটি এক ধরনের জুয়া খেলার মতো। যেখানে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা পণ্যের ডিও বা স্লিপ বিক্রি হয়। কিন্তু ক্রেতা-বিক্রেতারা জানেন না এই পণ্য কোথায়। এই ডিও বেচাকেনায় কোনো একটি পণ্যের দাম সর্বোচ্চ হয়ে হঠাৎ বড় দরপতন হয়। তখন ডিও বা স্লিপগুলো যাদের হাতে থাকে, তারা বড় লোকসানে পড়ে মার্কেট থেকে উধাও হয়ে যান।
চট্টলায় বেড়েছে টাকা হাতিয়ে পালানোর ঘটনা
১৯৮৬ সালের পর থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত খাতুনগঞ্জে কমপক্ষে ৬৮ জন ব্যবসায়ী বাজারে পাওনাদারদের টাকা পরিশোধ না করে গা ঢাকা দিয়েছেন। যারা বাজার থেকে নিয়ে গেছেন কমপক্ষে হাজার কোটি টাকা। শুধু খাতুনগঞ্জেই নয়, ব্যাপক হারে প্রতারণা বাড়ায় শহরজুড়ে এমন আতঙ্কে ব্যবসায়ীরা।
এমনই এক প্রতারকের নাম জুলকারনাইন মোহাম্মদ আরিফুর রহমান (৪৫)। তিনি জড়িত ছিলেন রয়েল সিমেন্টের বিক্রয় ও বিপণনের সঙ্গে। কিন্তু নিজেকে পরিচয় দিতেন রয়েল সিমেন্টের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে। এই পরিচয়ে বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিতেন কোটি কোটি টাকা। কেউ প্রতিবাদ করলেই তাকে দিতেন হুমকি, হামলার ধমকি। তবে শেষ পর্যন্ত মুখ খুলেছেন এক ব্যবসায়ী।
চট্টগ্রামের ওই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ২৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে মামলা করেছেন চট্টগ্রাম চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে। এই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে জারি হয়েছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। তাকে হন্য হয়ে খুঁজছে পুলিশ। এদিকে রয়েল সিমেন্টের নাম ভাঙিয়ে জুলকারনাইন যে প্রতারণা করত, বিষয়টি বুঝতে পেরেছে প্রতিষ্ঠানটিও। এমন অভিযোগ স্বীকার করে তাকে বিক্রয় ও বিপণনের চাকরি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
মন্তব্য করুন