জগলুল হুদা, রাঙ্গুনিয়া (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২৬ জুলাই ২০২৪, ০৮:২৫ এএম
অনলাইন সংস্করণ

ঝাড়ফুঁক করে অট্টালিকা গড়েছেন চট্টগ্রামের আইযুব বৈদ্য

রাঙ্গুনিয়ার নিশ্চিন্তাপুরের আইয়ুব বৈদ্যের বহুতল ভবন। ছবি : কালবেলা
রাঙ্গুনিয়ার নিশ্চিন্তাপুরের আইয়ুব বৈদ্যের বহুতল ভবন। ছবি : কালবেলা

চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার হোছনাবাদ ইউনিয়নের নিশ্চিন্তাপুর গ্রামের বাসিন্দা আইয়ুব খাঁন। সবাই চেনেন আইয়ুব বৈদ্য হিসেবে। চিকিৎসাসংক্রান্ত বিষয়ে কোনো ডিগ্রি না থাকলেও তার কাছে গেলে মেলে সব রোগের চিকিৎসা। নিজ বাড়িতে আসন বসিয়ে ঝাড়ফুঁক করেন। এমনকি রোগীদের বিভিন্ন শারীরিক পরীক্ষারও পরামর্শ দিয়ে স্থানীয় ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকেও নেন কমিশন।

এভাবেই আধ্যাত্মিক দান পাওয়ার কথা বলে ঝাড়ফুঁকের টাকা দিয়ে গড়েছেন অট্টালিকা, কামাই করেছেন লাখ লাখ টাকা। এসবের পাশাপাশি তিনি একই গ্রামের দক্ষিণ নিচিন্তাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন তিনি।

সরেজমিন ওই গ্রামে দেখা যায়, গ্রামের বাড়িতে ঢুকতে চোখে পড়ে দৃষ্টিনন্দন গেইট (ফটক)। ভিতরে প্রবেশ করতেই দৃষ্টি যায় পাকা দালানে। রহস্যময় এই বাড়িতে সবসময় সদর দরজা বন্ধ থাকে। ভেতর থেকে অনুমতি না মিললে কেউ ভেতরে ঢুকতে পারে না। এই ঘরের ভেতরে ঢুকতে দেখা যায়, ঘরের বারান্দায় কয়েকজন লোক বসে আছে। ভেতরে কাঠের বড় দরজা বন্ধ। বারান্দার সব দেয়ালে ঝোলানো রয়েছে হরিণের শিং ও খুলি।

রহস্যময় এই বাড়িতে দীর্ঘদিন ধরে চলছে কথিত এই চিকিৎসা। জিজ্ঞেস করতেই মমতাজ উদ্দিন নামে এক লোক বলে উঠল আইয়ুব বৈদ্য বিশ্রাম নিচ্ছেন। একটু আগে আসন থেকে উঠে গেছেন। ওনার ইচ্ছা হলে রোগী দেখতে পারেন আবার না-ও দেখতে পারেন।

ওনার কাছে চিকিৎসা নিতে আসা অপেক্ষারত এক ব্যক্তি বলে উঠলেন তিনি ঘণ্টা খানেক আগে এসেছেন। চিকিৎসক আসন থেকে উঠে যাওয়ার ১০ মিনিট আগে তিনি এসেছেন। একটু আগে আসতে পারলে হয়তো তিনি আজ চিকিৎসককে দেখাতে পারতেন। আদৌ তিনি ওইদিন চিকিৎসকের দেখা পেতে পারেন কিনা সন্দিহান রয়েছেন।

পরিচয় জানতে চাইলে ইমরান হোসেন নামের ওই ব্যক্তি কালবেলাকে জানান, রাঙামাটি কলেজে অনার্স পড়ছেন তিনি। আইয়ুব খানের গ্রামের এক আত্মীয়ের সুবাদে তিনি এই চিকিৎসককে খুঁজে পান। প্রচণ্ড মাথা ব্যথার কারণে ২০২২ সাল থেকে তিনি চিকিৎসা নিতে রাঙামাটি থেকে নিয়মিত আসেন। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী এরপর থেকে প্রতি ৬ মাস পরপর এখানে আসেন। প্রথমবার রোগের বিবরণ শুনে ১০ হাজার টাকা ফি নেন। তাকে ব্যবস্থাপত্রে কিছু ওষুধ লিখে দেন। প্রতি ৬ মাস পরপর ৫০০ টাকা করে চিকিৎসককে দিতে হয়। এর আগে তিনি অনেক চিকিৎসককে দেখিয়েছেন কিন্তু তার রোগ ভালো হচ্ছিল না। পরে এখানে আসার পর তিনি একটু সুস্থবোধ করছেন দাবি করেন।

রাঙ্গুনিয়া উপজেলার মুরাদনগর গ্রাম থেকে এসেছেন মো. সেলিম। তিনি বলেন, তিনি চিকিৎসা নিতে নিয়মিত আসেন। তিনি মানসিক বিষণ্নতায় ভুগছিলেন।

মাথার সমস্যার জন্য এসেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, রোগের ধরন অনুযায়ী ঝাড়ফুঁক করেন। আবার রোগ নির্ণয়ের জন্য ল্যাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেন। তিনি চিকিৎসার জন্য কত টাকা দিয়েছেন জানতে চাইলে বিষয়টি এড়িয়ে রোগের ধরন অনুযায়ী ওই চিকিৎসক টাকা নেন।

ওইদিন সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে আইয়ুব খানের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে এই প্রতিবেদক ঘণ্টা খানেক অপেক্ষা করে তার দেখা পাননি। পরে তার সহযোগী বন্ধ ঘরের ভেতর থেকে খবর আনেন, চিকিৎসক অসুস্থ । তিনি ওইদিন কারও সঙ্গে দেখা করতে পারবেন না। চিকিৎসা নিতে আসা লোকজনকেও চলে যেতে বলেন।

স্থানীয়রা জানান, পরনে সব সময় ধবধবে সাদা পোশাক থাকে। চলনে বলনে আধ্যাত্মিকতার ভাব। এসব করে তিনি মূলত নিজেকে আধ্যাত্মিক চিকিৎসক হিসেবে গড়ে তুলেছেন। আসনে বসে তিনি স্বামী-স্ত্রীর অমিল, মানসিক রোগ, নিঃসন্তান দম্পতির সন্তান পেতে সহায়তা, ক্যানসার, কিডনিসহ বিভিন্ন জটিল রোগের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন তিনি।

স্থানীয়দের দাবি, জিন সাধন করে মূলত তিনি এসব করে যাচ্ছেন। তবে তার কাছে চিকিৎসা নিয়ে ভালো হয়েছেন এ রকম নজির না থাকলেও মূলত বিশ্বাসের জোরে কিংবা কিছু দালাল মারফত প্রচারণায় তার এই ভুয়া চিকিৎসার প্রসার ঘটিয়ে চলেছেন এবং এটি অব্যাহতভাবে করে চলেছেন। কথিত এসব চিকিৎসা চালিয়ে নিতে সংশ্লিষ্ট সবপক্ষকে ম্যানেজ করেই মূলত তিনি এসব করে যাচ্ছেন।

জানতে চাইলে চন্দ্রঘোনা মা-মনি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ল্যাব টেকনেশিয়ান মোহাম্মদ শাহেদ জানান, ডাক্তার আইয়ুব বিভিন্ন রোগের পরীক্ষার জন্য প্রতি মাসে শতাধিক রোগী পাঠিয়ে থাকেন।

এই বিষয়ে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দানু মিয়া বলেন, দূরদূরান্ত থেকে প্রচুর লোকজন তার কাছে আসেন। চিকিৎসা নয় তিনি ঝাঁড়ফুঁকের মাধ্যমে পাগল ভালো করেন। চিকিৎসা বিষয়ে কোনো ডিগ্রি না থাকলেও তিনি জ্বিন হাজিরের মাধ্যমে এই চিকিৎসা দেন শুনেছেন। তবে তিনি মানুষের কাছ থেকে চেয়ে কোনো টাকা নেন না। মানুষ খেয়াল খুশিমতো দিলে নেন। এসব টাকা তিনি রাখেন না। আউলিয়ার ওরস করেন, নইলে টাকা মানুষকে দান করে দেন।

অভিযোগ রয়েছে, আইয়ুব খান বিদ্যালয়ে কম সময় দেন। কথিত চিকিৎসার কাজে সময় দেন বেশি। বিভিন্ন জটিল রোগের চিকিৎসা দেওয়ার কথা বলে মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা।

এই বিষয়ে সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শিবলু দাশ বলেন, যখন গিয়েছি, তাকে সব সময় স্কুলে পেয়েছি। নিয়মিত তিনি স্কুলে সময় দেন। ওই শিক্ষকের বিষয়ে কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। তবে তিনি মানুষকে চিকিৎসা দেওয়ার বিষয়টি শুনেছেন। তার বিষয়ে আরও খতিয়ে দেখা হবে।

এই ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রায়হান মেহেবুব বলেন, এই ব্যাপারে আমার জানা নেই। চিকিৎসাবিদ্যা না নিয়ে এভাবে চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ নেই। এই বিষয়ে তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিটিভিতে সরাসরি দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ–হংকং ম্যাচ

নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতে কাজ করছে রাজউক : চেয়ারম্যান

বিস্ফোরক অভিযোগ আবু ত্বহার স্ত্রীর

পিকে হালদারের সহযোগী তাজবীরের জামিন

চট্টগ্রামে মিলল বিপুল জাল টাকা

পেনাল্টিতে গোল হজম করে বিরতিতে হামজারা

১৭ থেকে ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত ২৯ জেলায় বৃষ্টির আভাস

মিরপুরের আগুনের ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১৬

নভেম্বরে গণভোট চাওয়াদের কোনো মাস্টারপ্ল্যান আছে কিনা, প্রশ্ন রিজভীর

ফ্রান্সে ‘আশা এবং আমার সংগ্রাম’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব

১০

শাপলা প্রতীক না পাওয়ার প্রশ্নে যা বললেন সারজিস আলম

১১

দুই গোলে এগিয়ে থেকেও জাপানের কাছে ব্রাজিলের হার

১২

ভারত থেকে উদ্ধার দুই বাংলাদেশি তরুণী

১৩

শিক্ষা উপদেষ্টাকে আইনি নোটিশ

১৪

বরিশাল সদর উপজেলা বিএনপির নতুন কমিটি ঘোষণা

১৫

সরিয়ে দেওয়া হলো শিক্ষার ডিজিকে 

১৬

ভিকারুননিসার ছাত্রীকে ধর্ষণ, যুবকের যাবজ্জীবন

১৭

গাজাকে নতুন করে নির্মাণ নিয়ে কী বলছেন ট্রাম্প

১৮

সিজেএফবি বিশেষ সম্মাননা পাচ্ছেন  / বেবী নাজনীন, পূর্ণিমা এবং কাজী জেসিন

১৯

শিশুশ্রম নিরসনে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে গণমাধ্যমকে এগিয়ে আসতে হবে

২০
X