কাপড় ও মোটরসাইকেল কেনাবেচার ব্যবসা কুষ্টিয়ার কুমারখালীর যুবক সাগর হোসেনের। দুই দশক ব্যবসা করে প্রাচীরঘেরা আধাপাকা বাড়ি তৈরি করেছিলেন। চলতেন দামি মোটরসাইকেলে। সবমিলিয়ে প্রায় ৩৬ লাখ টাকার সম্পত্তির মালিক ছিলেন সাগর। তবে এসব এখন তার কাছে শুধুই স্মৃতি। মাত্র এক বছরে অনলাইন জুয়া খেলে বাড়ি ও মোটরসাইকেল বিক্রি করে সর্বস্বান্ত তিনি। এমন সর্বনাশা জুয়া আর খেলবেন না বলে দুধ দিয়ে গোসল করেছেন তিনি।
শুক্রবার (০৯ মে) সন্ধ্যায় উপজেলার পান্টি ইউনিয়নের পান্টি গোলাবাড়ি বাজারে বেশকিছু মানুষের সামনে তিনি দুধ দিয়ে গোসল করেন। পরে রাত ১০টার দিকে সেই গোসলের এক মিনিট ৫৫ সেকেন্ডের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।
ভুক্তভোগী সাগর হোসেন ওই এলাকার মো. চাঁদ আলীর ছেলে।
ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, স্থানীয় কয়েকজন প্লাস্টিকের মগ ও কোমল পানির কাটা বোতল দিয়ে সাগরের মাথায় দুধ ঢালছেন। উৎসুক জনতা তাকে ঘিরে দেখছেন। কেউ কেউ মোবাইল ফোনে সেই দৃশ্য ধারণ করছেন। দুধ ঢেলে গোসলেল সময় সাগরকে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘প্রিয় ভাই ও আমার বন্ধুরা। আমার ছিল বিলাসিতা জীবন। পান্টি একটা মোটরসাইকেলের শোরুম ছিল। আমি খুব শখ করে একটা বাড়ি করেছিলাম। এই মোবাইলে (জুয়া) খেলা করে আমার শোরুম চলে গেছে, বাড়ি চলে গেছে। আমার এ দৃশ্য দেখে যদি কোনো লোক একজন ব্যক্তি ভালো হয়ে যান, ভালো। আমি রিসার্চ করেছি আমার এই মাথায় আমার নিজের কর্ম করা ছিল। আমি কর্ম করি বানাইছিলাম, আল্লাহ পাক আমায় দিয়েছিল। অসৎ পথে কেউ কোনো দিন বড়লোক হতি পারে না, রাতারাতি কেউ বড়লোক হতে পারে না। কোনো মানুষ এইটা দেখে (দুধ গোসল) সব শিক্ষাগ্রহণ করবেন জীবনে কেউ জুয়া খেলবেন না।’
ভিডিওতে আরও বলতে শোনা যায়, ‘দেহ শরীর সব নষ্ট করে ফেলেছি। আত্মহত্যার পথ বেঁচে নিছিলাম। তিনডে মেয়ে সন্তান আছে। সে জন্য আর কোনোদিন এই জুয়া খেলব না, খেলব না, খেলব না। মোবাইলের জুয়া আমি কোনোদিন খেলব না। আমি শপথ নিলাম।’
স্থানীয়ভাবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পান্টি গোলাবাড়ি বাজারের পাশেই সাগরের আধাপাকা বাড়ি। পাকা প্রাচীরে ঘেরা বাড়িটিতে লোহার গেট। বাড়ির ভিতরে ও প্রাচীরে জ্বলে বাহারি রঙের আলো। বাড়ির ভিতরের কক্ষগুলো সাজানো ও পরিপাটি।
যোগাযোগ করা হলে ভুক্তভোগী সাগর হোসেন জানান, মাত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। প্রথমে কাপড় কেনাবেচার ব্যবসা ছিল তার। পরে পুরাতন মোটরসাইকেলের শোরুম দিয়েছিলেন। সেখানে পুরাতন মোটরসাইকেল কেনাবেচা করতেন। সবই ভালো চলছিল। মাসে প্রায় ৪০ থেকে ৭০ হাজার টাকা আয় হতো। প্রায় ২১ বছর ধরে সৎপথে আয় করে বাড়ি, মোটরসাইকেল করেন। কিন্তু মাত্র এক বছরে অনলাইন জুয়া ‘ওয়ান এক্স বেট’ ও ‘গ্লোরি ক্যাসিনো’ খেলে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। ধারদেনা করেও জুয়া খেলেছেন ২১ লাখ টাকায় বাড়ি এবং ১৫ লাখ টাকার শোরুম বিক্রি করেও দেনা শোধ করতে পারেননি।
তার ভাষ্য, ব্যবসা বন্ধ করে ধারদেনা ও সুদে টাকা নিয়ে জুয়া খেলতেন। পরে সবকিছু বিক্রি করে দিয়েও এখনও সাড়ে ৩ লাখ টাকা দেনা। গত বৃহস্পতিবার আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন। পরে স্থানীয়রা টের পেয়ে দুধ দিয়ে গোসলের আয়োজন করে।
তিনি আরও জানান, পান্টি এলাকার শত শত মানুষ এই জুয়া খেলেন। আর কেউ যেন লোভে পড়ে সর্বস্বান্ত না হন। সে জন্য তিনি মানসম্মান ত্যাগ করে জনসম্মুখে দুধ দিয়ে গোসল করেছেন। জুয়ায় তিনি একদিনে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পেয়েছেন। আর হেরেছেন প্রায় তিন লাখ টাকা। যাওয়ার জায়গা নেই তাই ক্রেতার সম্মতিতে এখনও বিক্রিত বাড়িতেই থাকছেন তিনি।
ভুক্তভোগীর স্ত্রী কনা খাতুন বলেন, ‘অনলাইন জুয়ায় বাড়ি, মোটরসাইকেল, গহনা, আসবাবপত্র, সম্পদ সব চলে গেছে। আর কারো সঙ্গে যেন এমন না হয়।’
পান্টি বাজারে রাসেল কম্পিউটার দোকানের মালিক রাসেল হোসেন বলেন, ‘সাগরের আগে মোটরসাইকেলের শোরুম ছিল। দামি মোটরসাইকেল ও বাড়ি ছিল। তবে জুয়া খেলে এখন পথের ফকির। আর জুয়া খেলবে না বলে সন্ধ্যায় বাজারের ওপর দুধ দিয়ে গোসল করেছেন সাগর।’
স্থানীয় আরেক বাসিন্দা রাশিদুল ইসলাম বলেন, সবকিছু হারিয়ে সাগর আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল। কিন্তু আমরা ১০ কেজি দুধ দিয়ে গোসল করিয়ে তওবা পড়িয়েছি। যেন আর জুয়া না খেলে। আর অন্যরাও যেন সতর্ক হন। সেজন্য জনসম্মুখে গোসল করানো হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মিকাইল ইসলাম বলেন, দুধ দিয়ে গোসল করানোর খবর পেয়েছি। তবে সঠিক কারণ জানা যায়নি। অনলাইন জুয়ার বিষয়ে কেউ লিখিত অভিযোগ করলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কুমারখালী থানার ওসি মো. সোলায়মান শেখ কালবেলাকে বলেন, শুক্রবার রাতে স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের কাছ থেকে বিষয়টি শুনেছি। যেকোনো জুয়ার বিষয়ে আমরা সতর্ক আছি। জুয়াড়িদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। তবে কুমারখালীর পান্টিতে সাগর নামে এক ব্যবসায়ীর দুধ দিয়ে গোসল করার বিষয়ে স্থানীয় ক্যাম্প পুলিশকে জানানো হয়েছে। তারা আমাকে রিপোর্ট করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন