

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর কুষ্টিয়ার সীমান্তবর্তী দৌলতপুর উপজেলা ধীরে ধীরে অপরাধের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। গত ১৬ মাসে এই উপজেলায় দুই ডজন হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এছাড়া চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, বালু ঘাটসহ মাঠের ফসল দখল এমনকি প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া পর্যন্ত দিতে দেখা যাচ্ছে। এ সকল ঘটনায় প্রায় পাঁচ হাজার অভিযোগের ভিত্তিতে ৭৩৭টি মামলা হয়েছে।
অপরাধ দমনে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায় সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও ক্ষোভ বাড়ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, থানায় অভিযোগ করেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে মিলছে না কোনো প্রতিকার। তবে পুলিশ বলছেন সব স্বাভাবিক আছে।
এদিকে প্রতিদিনের ঘটনায় আতঙ্কে সাধারণ মানুষ, ভুক্তভোগীদের দাবি প্রকাশ্যে ছিনতাই, হামলা, অস্ত্রের মহড়া এখন নিয়মিত ঘটনা। প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই হচ্ছে। প্রকাশ্যে অ-প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি তো আছেই। আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক শত্রুতা ও মাদক ব্যাবসা ঘিরে প্রায়ই ঘটে যাচ্ছে সংঘর্ষ, হামলা-মামলা এবং হত্যাকাণ্ড। এছাড়া উপজেলার বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রমেও ঠিকাদারদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কাজের জায়গায় হামলা চালানো, উড়োচিঠিতে চাঁদা দাবি এগুলোও নিত্যদিনের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জানা গেছে, ১৬ মাসে ২৩টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে এ উপজেলায়। ২০২৪ সালের ২১ আগস্ট মরিচা ইউনিয়নে স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা মাইনুল ইসলামকে কুপিয়ে হত্যা, ২৪ আগস্ট আল্লারদর্গা বাজারে ভ্যানচালক বারু প্রামাণিককে প্রকাশ্যে মারধর করে হত্যা, ২৯ আগস্ট শ্রমিক রনির লাশ টয়লেট থেকে উদ্ধার, ৩০ আগস্ট সোনাইকুন্ডি উত্তরপাড়া গ্রামে পিকনিকে দুপক্ষের সংঘর্ষে আহত কলেজছাত্র রাব্বি হোসেন (২০) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু, ৩০ সেপ্টেম্বর প্রকাশ্যে দিবালোকে ইউপি চেয়ারম্যান নঈম উদ্দিন সেন্টুকে গুলি করে হত্যা, নভেম্বরে ছাতাপাড়া বাজারে দুই সহোদর ভাই হামিদুল ও নজরুল ইসলামকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা, ২৪ নভেম্বর আপেল লস্কর নামে মাছ ব্যবসায়ীকে লাঠির আঘাতে হত্যা করা হয়।
এরপর ২০২৫ সালেও হত্যাকাণ্ড আরও বাড়তে থাকে। রাজু (১৮) নামে যুবককে পদ্মার চরে গুলি করে হত্যা করা হয়, দৌলতখালী দাড়পাড়া গ্রামে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় জাহানারা খাতুন নামে এক প্রতিবন্ধীকে, গোবরগাড়া গ্রামে জমিসংক্রান্ত জেরে মাহাফুজা খাতুনকে (৪৬) ধারালো কুড়াল দিয়ে হত্যা করা হয়। ২৯ মে আরিফ নামে এক মাদক ব্যবসায়ীকে হত্যা করা হয়, সীমান্তের ঠোটারপাড়ায় মাদক চোরাচালান সংক্রান্ত পূর্ব বিরোধের জের ধরে প্রতিপক্ষ মাদক চোরাকারবারির হামলায় মাদক চোরাকারবারি মোহন (২৫) নিহত হয় এবং আহত হয় হৃদয় (২৪) নামে অপর মাদক চোরাকারবারি। মরিচা ইউনিয়নের ভুরকাপাড়ায় শহিদুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। গত ২৯ জুন শেরপুর সেনপাড়া গ্রামের শিলা খাতুন (২০) নামে গৃহবধূর গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় বলে পরিবারের দাবি। ২ জুলাই রাতে মথুরাপুর স্কুল বাজারে প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে আব্দুল আজিজ (৩০) নামে এক যুবক নিহতের ঘটনা ঘটে। এছাড়াও গত ২৫ আগস্ট মুখবাধা অবস্থায় মাঠ থেকে জাইমা খাতুন (৫৫) নামে মানসিক ভারসাম্যহীন নারীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ৯ সেপ্টেম্বর বাগোয়ান কান্দিরপাড়া এলাকায় সার্ফান সরদাকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ২৪ অক্টোবর জাহিদুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তিকে হত্যা করে তার ভাইয়েরা। গত ২৭ অক্টোবর পদ্মার চরে খড়ের মাঠ দখলকে কেন্দ্র করে দুই বাহিনীর বন্দুক যুদ্ধে আমান মন্ডল (৩৬) ও নাজমুল মন্ডল (২৬) এবং লিটন আলী (২৬) নিহত হন। সবশেষ গত ৬ নভেম্বর ইনসাফ নগর গ্রামে আড়াই বছরের শিশু লামিয়া খাতুনকে তার মা হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করেন। সব মিলিয়ে গত ১৬ মাসে মোট ২৩টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। এছাড়াও পাঁচ হাজারের অধিক অভিযোগের ভিত্তিতে ৭৩৭টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে।
এসব অপরাধে জড়িত অনেক আসামি গ্রেপ্তার হলেও আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেশিরভাগই জামিনে বের হয়ে পুনরায় অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। এতসব অপরাধের পরও পুলিশ প্রশাসন পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক দাবি করছে। কিন্তু জনপ্রতিনিধি ও ভুক্তভোগীরা বলছেন প্রশাসনের কঠোর ভূমিকা না থাকায় অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
তবে এসব ঘটনার দায় নিতে নারাজ দৌলতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সোলায়মান শেখ। দৌলতপুরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির পরও তিনি কালবেলার কাছে দাবি করছেন, সবকিছুই স্বাভাবিক রয়েছে।
এ বিষয়ে ভেড়ামারা-দৌলতপুর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দেলোয়ার হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর সারাদেশের মতো দৌলতপুরেও আইন-শৃঙ্খলার কিছুটা অবনতি দেখা দিয়েছিল। আমার এখানে দায়িত্ব নেওয়া মাত্র দুই মাস হয়েছে। বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অবস্থানে রয়েছে, যার ফলে এলাকায় অপরাধের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসেছে।’
এদিকে বর্তমান অপরাধ পরিস্থিতি নিয়ে স্থানীয়দের একটাই দাবি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও সক্রিয়, কঠোর ও স্বচ্ছ ভূমিকা নিতে হবে। তবেই দৌলতপুরের মানুষ স্বস্তি ফিরে পাবে এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রা নিশ্চিত হবে।
মন্তব্য করুন