ইমন চৌধুরী, কাপ্তাই (রাঙামাটি)
প্রকাশ : ২৩ মে ২০২৫, ১১:০২ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

কাপ্তাই হ্রদে পানির অভাব, বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিপর্যয়

রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদ। ছবি : কালবেলা
রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদ। ছবি : কালবেলা

রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই হ্রদ বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ কৃত্রিম জলাধার। ষাটের দশকে দেশের একমাত্র পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের লক্ষ্যে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে এ জলাধারের সৃষ্টি।

এই হ্রদ রাঙামাটির পরিবেশ, সমাজ ও অর্থনীতির চালিকাশক্তি হলেও সাম্প্রতিক সময়ে পানি হ্রাস পাওয়ায় তা হয়ে উঠেছে দুর্ভোগের উৎস। পাহাড়ি অঞ্চলের জনগোষ্ঠী, ব্যবসায়ী, কৃষক, পরিবহনকর্মী এবং বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী- সবাই এখন এই সংকটের সরাসরি ভুক্তভোগী।

বৃষ্টির অভাবে হ্রদে পানির স্তর দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে হ্রদনির্ভর যাতায়াত প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। কাপ্তাই উপজেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, জেটিঘাট বাজারে গিয়ে দেখা যায়, পানি কমে যাওয়ায় ইঞ্জিনচালিত বোটগুলো স্বাভাবিকভাবে চলতে পারছে না। ভাড়া বেড়েছে কয়েকগুণ।

স্থানীয় বোটচালক মো. সোহেল জানান, ‘অনেক জায়গায় বোট আটকে যাচ্ছে, ঠেলে নিয়ে যেতে হয়। বড় বোট যেতে পারছে না, তাই ছোট বোটে চলাফেরা করতে হয়। এতে আমাদের কষ্ট হয়, আর যাত্রীদেরও অনেক ভোগান্তি হয়।’

তার সঙ্গে একমত রতন দাশ। তিনি বলেন, ‘পানি যেভাবে কমছে, তাতে অনেক পাহাড়ি জায়গায় যাওয়া এখন প্রায় অসম্ভব। কাপ্তাই হ্রদের নিচে কাদায় বোট বসে যাচ্ছে, ঠেলা না দিলে চলে না। এ অবস্থা আগে হতো না।’

প্রতিদিন এই পথ ব্যবহারকারী আয়েশা বেগম, চিংনু মারমা এবং সুব্রত বড়ুয়া বলেন, ‘এই দুর্ভোগ প্রতি বছর হয়। সরকার শুধু আশ্বাস দেয়, বাস্তবে কিছুই করে না। ড্রেজিংয়ের কথা বহুবার শুনেছি, কিন্তু কাজ এখনো শুরু হয়নি।’

কাপ্তাই জেটিঘাট বাজার তিন পার্বত্য জেলার বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু পানির অভাবে নৌপথে ফসল ও সরঞ্জাম পরিবহন ব্যাহত হওয়ায় বাজার কার্যত অচল। আগের মতো এখন আর পাহাড়ি অঞ্চল থেকে মৌসুমি ফল, কাঁচামাল ও কৃষিপণ্য আসছে না। ফলে চাষিরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি বিপাকে পড়েছেন শ্রমজীবীরাও।

মো. আকবর নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘আগে দিনে ৪-৫টি ট্রিপে মাল আনতাম। এখন সপ্তাহে একটা ট্রিপও হয় না। পাহাড় থেকে ফসল আসে না, কাজ নেই। আয় একেবারে কমে গেছে।’ রহমত আলী বলেন, ‘পানি কম, বোট চলে না। ফলে চাষিরাও আর আসতে চান না। তারা বলেন, বোট ভাড়া বেশি, লাভ হয় না। আমরাও কাজ না পেয়ে বসে থাকি।’

হারাধন দাশ বলেন, ‘ছোট বোটে সামান্য মাল আনা যায়, তা বিক্রি করে ফায়দা পাওয়া যায় না। সবকিছু মিলে শ্রমিকদের দুর্দশা বাড়ছে।’

বিদ্যুৎ উৎপাদনে চরম বিপর্যয় : দেশের একমাত্র পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্ণফুলী পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র বর্তমানে কাপ্তাই হ্রদের পানির সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যর্থ। পাঁচটি ইউনিটের মধ্যে মাত্র একটি সচল। বিদ্যুৎ উৎপাদন নেমে এসেছে দৈনিক ৩৫-৪০ মেগাওয়াটে, যেখানে পূর্ণ সক্ষমতায় এটি উৎপাদন করতে পারে ২২০-২৪০ মেগাওয়াট।

বিদ্যুৎকেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, ‘পানির উচ্চতা না বাড়লে বাকি ইউনিটগুলো চালু করা সম্ভব নয়।’ ফলে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে, যার প্রভাব সারা দেশে পড়ছে।

চট্টগ্রামের পানিতেও প্রভাব : বিদ্যুৎ উৎপাদনের পর কাপ্তাই হ্রদের পানি কর্ণফুলী নদীতে প্রবাহিত হয় এবং এই নদীর পানি শোধন করে চট্টগ্রাম ওয়াসা নগরবাসীর জন্য সরবরাহ করে। নদীর প্রবাহ কমে গেলে লবণাক্ততা বাড়ে। ফলে পরিশোধিত পানির গুণগত মান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এভাবেই কাপ্তাই হ্রদের পানির স্বল্পতা চট্টগ্রামের প্রায় অর্ধকোটি মানুষের পানীয়জল ব্যবস্থায় প্রভাব ফেলছে।

পলিমাটিতে হারিয়ে যাচ্ছে গভীরতা : স্থানীয় সচেতন মহলের মতে, হ্রদের কিছু অংশে দীর্ঘদিনের পলি জমে গভীরতা কমে গেছে। ফলে হ্রদ এখন তার পানি ধারণক্ষমতা হারাতে বসেছে।

এই বিষয়ে রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ কালবেলাকে বলেন, ‘কাপ্তাই হ্রদের পানি কমে গেলে ৩-৪টি উপজেলার মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, আবার বেশি পানি হলে কৃষিকাজ ব্যাহত হয়। এটি একটি স্ট্র্যাটেজিক সমস্যা। এর সমাধান ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে সম্ভব। এরই মধ্যে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কাজ চলছে। সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ হয়েছে। আমরা আশাবাদী, কাজটি শিগগির শুরু হবে।’

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, কাপ্তাই হ্রদের আদর্শ পানি ধারণক্ষমতা ১০৯ এমএসএল। গত বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত হ্রদের পানি মাত্র ৭৬.৭৯ এমএসএল ছিল, যা স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ১৬.১১ এমএসএল কম। এই বিশাল ঘাটতি শুধু স্থানীয় জনগণ নয়, দেশের জ্বালানি ও জল সরবরাহ ব্যবস্থার জন্যও হুমকি।

কাপ্তাই হ্রদের পানির এই সংকট শুধু একটি অঞ্চলের সমস্যা নয়, এটি জাতীয় পর্যায়ের একটি পরিবেশ, জ্বালানি ও অর্থনীতিনির্ভর সংকট। নৌপথ সচল রাখা, কৃষক ও শ্রমজীবীদের রক্ষা করা, বিদ্যুৎ উৎপাদন স্বাভাবিক রাখা এবং চট্টগ্রামে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য দ্রুত ও কার্যকর উদ্যোগ, বিশেষ করে ড্রেজিং প্রকল্প বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতার পদত্যাগ

চবি তেপান্তর সাহিত্য সভার নেতৃত্বে আবদুল মোমেন-রিয়াদ উদ্দিন

বৈষম্যবিরোধী সমন্বয়কদের দুগ্রুপের সংঘর্ষে আহত ৪

সৈকতে পড়ে আছে মৃত ডলফিন, ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ

পতেঙ্গা সৈকতে গোলাগুলি, ঢাকাইয়া আকবরসহ গুলিবিদ্ধ ২

কারাবন্দি সোহাগের মৃত্যু নিয়ে ধোঁয়াশা

তারেক রহমানকে নিয়ে অশালীন মন্তব্য বরদাস্ত করা হবে না : ইয়াসিন ফেরদৌস মুরাদ

ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনের শিডিউল / সরকারকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠালেন আ.লীগের এমপি হতে চাওয়া আইনজীবী

স্বাস্থ্য পরামর্শ / টিনিটাস: কানে অস্বাভাবিক শব্দ

কৃষকের সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক দ্বার খুলতে পারে বায়োচার

১০

জাতীয় ঐক্য সমুন্নত রাখার আহ্বান ছাত্রশিবিরের

১১

বিএনপিকে ডেকেছেন প্রধান উপদেষ্টা

১২

যাত্রাবাড়ী পার্কে ককটেল বিস্ফোরণ

১৩

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর বৈঠক শনিবার

১৪

আড়াইহাজারে শহীদ নাহিদের পরিবারের পাশে নজরুল ইসলাম আজাদ

১৫

নিউইয়র্ক টাইমসের বিরুদ্ধে আদিবাসী গোষ্ঠীর মামলা

১৬

পিনাকী, ইলিয়াস ও কনকের ঐক্যবদ্ধ আহ্বান

১৭

সকাল ৯টার মধ্যে ১০ জেলায় ঝড়ের আশঙ্কা

১৮

খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন, আ.লীগ নেতার মৃত্যু

১৯

কাপ্তাই হ্রদে পানির অভাব, বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিপর্যয়

২০
X