দুই পা বাঁধা অবস্থায় ভ্যান থেকে ভরা নদীতে পড়ে স্রোতের তোড়ে প্রায় ১৩ কিমি ভেসে গিয়েও বেঁচে ফিরে অবাক করে দিয়েছে মৃগী রোগী ও প্রতিবন্ধী জয়নাল। ঘটনাটি ঘটেছে জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার তুলশীগঙ্গা নদীতে।
সোমবার (২ জুন) দুপুরে জেলার ক্ষেতলাল উপজেলার বিলের ঘাট ব্রিজ থেকে তুলশীগঙ্গা নদীতে পড়ে নিখোঁজ হন প্রতিবন্ধী জয়নাল আবেদীন। পরে বিকেলে বিলের ঘাট থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার দূরে পার্শ্ববর্তী আক্কেলপুর উপজেলার নবাবগঞ্জ ঘাট এলাকা থেকে তাকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।
তিনি ক্ষেতলাল পৌর এলাকার ভাসিলা ফকিরপাড়া গ্রামের মৃত আশরাফ আলীর ছেলে।
জানা গেছে, ব্যাটারিচালিত অটোভ্যান নিয়ে এলাকায় ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করতেন জয়নাল আবেদীন। অনেক আগে একটি দুর্ঘটনায় তার কোমর ভেঙে যায়। এছাড়াও তিনি মৃগী রোগে আক্রান্ত ছিলেন। এই কারণে তার পা সবসময়ই বাঁধা অবস্থায় রাখা হতো। সোমবার সকালে তিনি ভিক্ষা করার উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হন। দুপুরে ক্ষেতলাল উপজেলার তুলশীগঙ্গা নদীর বিলের ঘাট এলাকায় পৌঁছালে হঠাৎ শুরু হয় তার মৃগীর উপসর্গ শুরু হয় এবং অসুস্থ অবস্থায় তিনি ব্রিজ থেকে পড়ে যান নদীতে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা তাৎক্ষণিক নদীতে নেমে তাকে উদ্ধারের চেষ্টা শুরু করেন এবং উপজেলা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সকে খবর দেওয়া হয়। ততক্ষণে ধারণা করা হয়- প্রতিবন্ধী জয়নাল প্রাণ হারিয়ে নদীর পানিতে তলিয়ে গেছে।
উপজেলা ফায়ার সার্ভিসের কাছে নদীতে নেমে উদ্ধার কাজ করার মতো সরঞ্জাম না থাকায় লাশ উদ্ধারের জন্য রাজশাহী থেকে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দলকে ডাকা হয়। তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছার পূর্বেই বিকেলে খবর আসে প্রতিবন্ধী জয়নাল নদীতে পড়ে ভরা নদীর প্রবল স্রোতে ভেসে যেতে যেতে প্রায় ১৩ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে পার্শ্ববর্তী আক্কেলপুর উপজেলার নবাবগঞ্জ ঘাট এলাকায় গিয়ে পৌঁছান। বিকেলে নদীর তীরে খেলতে থাকা কয়েক যুবক তাকে পানিতে ভাসতে দেখে উদ্ধার করেন এবং জীবিত দেখে দ্রুত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে ভর্তি করান। সেখান থেকে সুস্থ হয়ে তিনি বাড়ি ফেরেন।
এমন একটি আশ্চর্যজনক ঘটনা দুই উপজেলার মানুষকে অবাক করে দিয়েছে। কেউ কেউ বলছে এটি একটি অলৌকিক ঘটনা।
পরে সে খবর পেয়ে আক্কেলপুর হাসপাতালে ছুটে যান ক্ষেতলাল উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা আসিফ আল জিনাত। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন ক্ষেতলাল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ফরিদ উদ্দিন, ক্ষেতলাল উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ওবায়দুল হক, ক্ষেতলাল প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক হাসান আলী।
নবাবগঞ্জ ঘাট এলাকার ফিরোজ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, বিকেলে তুলশীগঙ্গা নদীর তীরে আমরা খেলছিলাম। এ সময় নদীতে একজনকে ভেসে যেতে দেখে আমরা কয়েকজন নদীতে নেমে তাকে জীবিত উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে দেই। এ সময় তার দুই পা দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল।
প্রতিবন্ধী জয়নাল আবেদীন কালবেলাকে বলেন, রোগের কারণে আমার পা সব সময় বাঁধা থাকে। আমি নদীতে কখন কীভাবে পড়ে গেছি তা মনে নেই। পরে জ্ঞান আসলে আমি নিজেকে হাসপাতালে দেখি।
হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক রায়হানুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, অচেতন অবস্থায় নদী থেকে এক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে স্থানীয়রা হাসপাতালে নিতে আসে। তাকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিলে তার জ্ঞান ফিরলে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে রেফার্ড করা হয়।
ক্ষেতলাল প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক হাসান আলী কালবেলাকে বলেন, প্রতিবন্ধী জয়নাল আবেদীনের ঘটনাটি একটি অলৌকিক ঘটনা। একজন প্রতিবন্ধী মৃগী রোগী পা বাঁধা অবস্থায় স্রোত-ভরা নদীতে পড়ে ১৩ কিলোমিটার ভেসে গিয়েও জীবিত ফেরার ঘটনা যেমন বিরল তেমনি আশ্চর্যজনক। আমরা তার পূর্ণ সুস্থতা কামনা করি।
তিনি আরও বলেন, সে দীর্ঘদিন থেকে মৃগী রোগ এবং ভাঙা কোমর নিয়ে অসহায় জীবন যাপন করছে। একটি দুর্ঘটনায় তার কোমরও ভেঙে যায়। তার নিজের কোনো ঘরও নেই। এমন অবস্থায় সে মানুষের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে চিকিৎসা এবং জীবনযাপন করে। খবর পেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাকে দেখতে ছুটে গিয়েছিলেন। তিনি জয়নালকে চিকিৎসার জন্য নগদ কিছু অর্থও দিয়েছেন এবং নিজস্ব ঘর না থাকায় তাকে নিজস্ব ঘর দেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
ক্ষেতলাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসিফ আল জিনাত কালবেলাকে বলেন, জয়নাল আবেদীন নামের একজন প্রতিবন্ধী যুবক ক্ষেতলাল উপজেলার বিলের ঘাটে তুলসীগঙ্গা নদীতে পরে নিখোঁজ হয়েছে বলে একটি খবর আসে। খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দলকে খবর দিয়েছিলাম। সে মোতাবেক তারা নদীতে খোঁজাখুঁজির প্রস্তুতি নিয়েছিল। আমরা ধারণা করেছিলাম সে আর বেঁচে নেই। এমন সময় খবর পাওয়া যায় সে আক্কেলপুরে উদ্ধার হয়েছে এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি আছে। তাৎক্ষণিক ওসি, পিআইও সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে তাকে দেখতে আক্কেলপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাই। কিন্তু সেখানে গিয়ে জানতে পারি সে রিলিজ নিয়ে বাড়িতে ফিরেছে। পরে তার বাড়িতে গিয়ে শারীরিক খোঁজখবর নিয়েছি এবং চিকিৎসার জন্য নগদ কিছু অর্থ দিয়েছি।
মন্তব্য করুন