নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আদুরী আক্তার। গত বছরের মার্চ মাসে না জানিয়েই আদুরীর বিয়ে ঠিক করে ফেলে পরিবার। বিয়েতে রাজি না হয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ স্থানীয় গণ্যমান্যদের কাছে অভিযোগ করে আদুরী। আদুরীর বাবা বিয়ে ঠিক করার বিষয় অস্বীকার করলেও এক রাতে অন্য এক বাড়িতে নিয়ে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।
তখন স্থানীয় উন্নয়নকর্মী জেসমিন আখতারকে জানালে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পুলিশ নিয়ে এসে বাল্যবিয়ে ভেঙে দেন। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে কাজী, বর, বরের বোন ও বাড়ির মালিককে তিন মাসের সাজা দেওয়া হয়।
সোমবার (২ জুন) দুপুরে রংপুরে আরডিআরএস মিলনায়তনে জননী প্রকল্পের আওতায় বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে ম্যাস মিডিয়া ক্যাম্পেইনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এ গল্প শোনায় আদুরী। সেভ দ্য চিলড্রেনের কারিগরি সহায়তায় মাতৃ ও নবজাতকের মৃত্য কমাতে ‘জননী’ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে আরডিআরএস বাংলাদেশ।
আদুরী আক্তার পীরগঞ্জের রসুলপুর মাহতাবিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্রী। তার বাড়ি ওই এলাকার পলাশবাড়ি গ্রামে। তার বাবা জাহাঙ্গীর আলম পেশায় একজন ভ্যানচালক।
আদুরী বলেন, আমি যদি বিয়ে করতাম তাহলে জীবনে এগিয়ে যেতে পারতাম না। পড়াশোনা করতে পারতাম না। ওখানে আমার লাইফ শেষ হতে যেত। আমি জীবনে স্বনির্ভর হতে চাই। এ ঘটনার পর থেকে পুরো পরিবার আমাকে সমর্থন দিচ্ছেন। স্বপ্নপূরণে পরিবার আমার পাশে আছেন।
এ সময় আদুরীর স্কুল রসুলপুর মাহতাবিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রধান শিক্ষক আবেদুল ইসলাম বলেন, বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে আদুরী এখন তাদের এলাকার দৃষ্টান্ত।
এ অনুষ্ঠানে রংপুর বিভাগের বাল্যবিবাহের চিত্র তুলে ধরা হয়। তথ্য অনুযায়ী, রংপুর বিভাগে বাল্যবিবাহের হার ৬৮ শতাংশ যেখানে জাতীয় গড় হার ৫০ শতাংশ। রংপুর বিভাগে ১৮ বছরের আগে গাইবান্ধায় ৭৬ দশমিক ৭ শতাংশ, দিনাজপুরে ৭০ দশমিক ৬ শতাংশ, ঠাকুরগাঁওয়ে ৬৭ দশমিক ৫ শতাংশ, নীলফামারীতে ৬৪ দশমিক ৩ শতাংশ, কুড়িগ্রামে ৬২ দশমিক ৩ শতাংশ, পঞ্চগড়ে ৬১ দশমিক ৪ শতাংশ ও রংপুরে ৫৩ দশমিক ৮ শতাংশ কিশোরীর বিয়ে হয়। ১৬ বছরের আগে বেশি মেয়ে শিশুর বিয়ে গাইবান্ধাতে। গাইবান্ধায় এ হার ৪৪ দশমিক ১। এরপরে ঠাকুরগাঁওয়ে ৩৪ দশমিক ১, দিনাজপুরে ৩২ দশমিক ৭, নীলফামারীতে ৩১ দশমিক ৮, পঞ্চগড়ে ২৬ দশমিক ৬, রংপুরে ২৫ দশমিক, লালমনিরহাটে ১৯ দশমিক ৭ ও কুড়িগ্রামে ১৭ দশমিক ৫।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত বক্তারা বলেন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে বিবাহ নিবন্ধনকে অনলাইন করা, কাজীরা একাধিক নিববন্ধন বই ব্যবহার করে কিনা তা নজরদারি করা, মিডিয়ার অপসংস্কৃতি রোধ করা, ধর্মের সঙ্গে সামাজিক মেলবন্ধন করা ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়গুলো কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে তুলে ধরতে হবে।
এ সময় বক্তব্য দেন রংপুর ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. রুহুল আমিন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জয়নাল আবেদীন, ইসলামি ফাউন্ডেশনের পরিচালক মোস্তফা মনসুর আলম খান, পরিবার পরিকল্পনার উপপরিচালক সাইফুল ইসলাম, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক সেলোয়ারা বেগম, জননী প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ডা. উজ্জ্বল কুমার রায় প্রমুখ। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন স্কুলকলেজের শিক্ষক, কিশোর-কিশোরী, অভিভাবক, ইমাম, গণমাধ্যমকর্মী ও প্রকল্পের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
রংপুর পরিবার পরিকল্পনার উপপরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, ১৫-২০ বছর আগে বাল্যবিবাহের হার ছিল ৫৯ শতাংশ। এত বছর পরে মাত্র ৯ শতাংশ কমেছে। এখনও চরাঞ্চল ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে ৭০-৮০ শতাংশ বাল্যবিবাহ হয়।
বক্তারা বাল্যবিবাহের কিছু উল্লেখযোগ্য কারণ তুলে ধরেন। সেগুলো হলো অভিভাবকের অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা, মেয়েকে নিয়ে সামাজিকভাবে নিরাপত্তাহীন ভাবা, ঘটক দ্বারা প্রভাবিত হওয়া, স্থানীয় কমিউনিটি ও স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয়হীনতা, জন্ম ও বিবাহ নিবন্ধন ও বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন নিয়ে সচেতনতার অভাব।
অনুষ্ঠানের শুরুতে জননী প্রকল্পের কারিগরি বিশেষজ্ঞ সৈয়দা জামিলা সিদ্দিকা প্রকল্প এবং ক্যাম্পেইনের উদ্দেশ্য ও কার্যক্রম উপস্থাপন করেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন জননী প্রকল্পের কারিগরি বিশেষজ্ঞ জাহানারা হৃদিতা।
মন্তব্য করুন
আর্কাইভ 
| ০৫ জুন ২০২৫ 
