আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ধর্মবিষয়ক উপকমিটির সদ্য সাবেক সদস্য মো. শামসুল ইসলাম কর্নেল (অব.) অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টিতে (এলডিপি) যোগদান করেছেন। জুলাই-গণঅভ্যুত্থানের সময় ছাত্র-জনতার ওপর হামলার মামলায় জেলে গিয়েছিলেন এই আওয়ামী লীগ নেতা। গত ২ মার্চ চট্টগ্রাম নগরের চকবাজার এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর জামিনে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দলবদল করলেন মো. শামসুল ইসলাম।
শুধু তিনিই নন, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের পদ ছেড়ে এলডিপি যোগ দিয়েছেন পাঁচজন। তাদের চারজনই সাবেক-বর্তমান জনপ্রতিনিধি। বিষয়টি নিয়ে দলটির ভেতর-বাইরে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে।
গত ১৯ থেকে ২১ জুনের মধ্যে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার সভাপতি মো. এয়াকুব আলীর কাছে তারা সদস্যপদের ফরম জমা দেন। এলডিপি যোগদানকারীরা হলেন—আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ধর্মবিষয়ক উপকমিটির সদ্য সাবেক সদস্য মো. শামসুল ইসলাম, উত্তর সাতকানিয়া যুবলীগের নেতা ও কেঁওচিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মো. মনির আহমদ, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও ইউপি সদস্য আবু তালেব সিকদার, সাহেব মিয়া এবং ইউপি সদস্য ও মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী রোকেয়া বেগম।
জানা যায়, আওয়ামী লীগ নেতা শামসুল ইসলামের বাড়ি সাতকানিয়া উপজেলার কেঁওচিয়া ইউনিয়ন এলাকায়। ওই এলাকায় তার মালিকানাধীন কয়েকটি ইটভাটা রয়েছে। আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়ার অত্যন্ত অনুগত এই নেতার বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে অর্থ সহায়তা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বিপ্লব বড়ুয়ার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের পদটি বাগিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। বিপ্লব বড়ুয়ার কারণে গণভবনে অবাধে যাতায়াত ছিল তার।
এ পাঁচজনের এলডিপিতে যোগদান নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নানা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন এলাকার বিভিন্ন দলের কর্মী-সমর্থকরা। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের একাধিক নেতাকর্মীর অভিযোগ, মনির আহমদ উত্তর সাতকানিয়া যুবলীগের নেতা থাকার সময় দলীয় কোন্দল কাজে লাগিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ২০১৬ সালের ৪ জুন কেঁওচিয়া ইউপি চেয়ারম্যান পদে জয়ী হন। তিনি নৌকার প্রার্থী একই সংগঠনের উত্তর সাতকানিয়ার সভাপতি ওচমান আলীকে পরাজিত করেন। পরে দলের দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়ার পিএস মো. আরিফের হাত ধরে শীর্ষ নেতাদের কাছে পৌঁছে যান। বিপ্লব বড়ুয়ার ব্যক্তিগত ও দলীয় উপহারসামগ্রী বিতরণের কর্মসূচিও তিনি দেখভাল করতেন।
এ ছাড়া ইউপি সদস্য আবু তালেব সিকদার ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাতকানিয়া থানায় হওয়া মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। সম্প্রতি এতে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারেও যান। পরে জামিনে বের হন। সাহেব মিয়া ও রোকেয়া বেগমও দলটির নানা কর্মসূচিতে সামনের সারিতে থাকতেন।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি আবুল কালাম আজাদ এসব বিষয়ে ফেসবুকে লেখেন, ‘সাতকানিয়ার বড় বড় আওয়ামী লীগ নেতার শ্রেষ্ঠ আবিষ্কারগুলোর অন্য দলে যোগদানের হিড়িক চলছে।’
সাবেক ছাত্রলীগ নেতা লুৎফর রহমান মাসুম ফেসবুকে মন্তব্য করেন, ‘জাতীয় বেইমানদের চিনে রাখবে প্রিয় কেঁওচিয়াবাসী।’
জামায়াতে ইসলামীর কেরানীহাট শাখার নেতা কাজী মো. ওসমান গণি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘এগুলো কারা...? হায় রে এলডিপি! কেঁওচিয়ার আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন চলছে...।’
মো. শফিউল আলম নামের একজন নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে লিখেছেন, আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এলে তারা আবার শামসুল ইসলাম ও মনির আহমদকে দলে ফিরিয়ে আনবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের এসব লোকজন কীভাবে বীর মুক্তিযোদ্ধা অলি আহমদের দলে থাকতে পারেন, এমন কথা লিখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন আজিজুল হক নামের একজন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মো. শামসুল ইসলাম বলেন, অলি সাহেব আমার এলাকার এমপি ছিলেন। আমি অন্য কাজে ঢাকায় গিয়ে উনার সঙ্গে দেখা করেছি। মূলত আমি কেঁওচিয়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করার চিন্তা করেছিলাম। আমার এলাকার সমর্থকেরা জোর করে এলডিপিতে যোগ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন। পরিবারসহ ঘনিষ্ঠজনের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব।
এলডিপিতে যোগ দেওয়ার বিষয়ে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মনির আহমদ বলেন, আমি আওয়ামী লীগের একজন সমর্থক ছিলাম। দলে আমার কোনো পদপদবি ছিল না। বর্তমানে আমি এলডিপির সমর্থক হিসেবে ফরম পূরণ করেছি।
অভিযোগের বিষয়ে আবু তালেব বলেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে কিছুই পাইনি। তবে মানুষের সঙ্গে কোনো অন্যায় আচরণ ও অত্যাচার করিনি। তারপরও জেল-জুলুমের শিকার হয়েছি। তাই সদস্য ফরম পূরণ করে এলডিপিতে যোগদান করেছি।
সাবেক ইউপি সদস্য সাহেব মিয়া বলেন, আমাদের (কেঁওচিয়া) পরিষদের চেয়ারম্যান ওসমান আলী আওয়ামী লীগের ছিলেন। তাই ইউপি সদস্য হিসেবে বাধ্য হয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলাম। কর্নেল অলি আহমদ একজন পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ। তাই উনার দলে যোগ দিয়েছি। আগামী নির্বাচনে চট্টগ্রাম-১৪ আসনে তার পক্ষে কাজ করব ইনশাআল্লাহ।
ইউনিয়ন মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উত্তর সাতকানিয়া আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক রোকেয়া বেগমের কাছে দলবদলের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
এলডিপির চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা সভাপতি মো. এয়াকুব আলী বলেন, স্থানীয় নেতাদের মাধ্যমে তারা প্রাথমিক সদস্যপদ পূরণ করেছেন। তারা আওয়ামী লীগের কোনো পদে ছিলেন না বলে স্থানীয় নেতারা জানিয়েছেন। এমনিতে হয়তো নানা কারণে চাপের মুখে কর্মসূচিতে গিয়েছেন। তবে তারা যোগ দেওয়ার পর থেকে বিভিন্ন অভিযোগ আসছে। বিষয়টি নিয়ে দলীয়ভাবে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। এ রকম কেউ আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে এলডিপিতে যোগ দিলে তাকে তদন্ত করে বরখাস্ত করা হবে।
মন্তব্য করুন