শুল্ক বিভাগের টানা কলম বিরতির পাশাপাশি দুই দিনের কমপ্লিট শাটডাউন শেষে পুনরায় কাজে যোগ দিয়েছেন কাস্টমস ও কর বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কর্মবিরতির কারণে সারা দেশের মতো চট্টগ্রামেও আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাসে মারাত্মক জট সৃষ্টি হয়। সরকারের রাজস্ব আদায়েও বড় ধরনের প্রভাব পড়ে।
তবে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজে যোগ দেওয়ায় পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। কিন্তু এমন কমপ্লিট শাটডাউনের কারণে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের অন্তত কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।
সোমবার (৩০ জুন) কাস্টমস খুললেও জমে থাকা ফাইলগুলোর শুল্কায়ন বিলম্বিত হচ্ছে। তবে কাস্টমস কর্মকর্তারা একটু বাড়তি কাজ করলে কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে জানা গেছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, আমদানি করা কাঁচামালের শুল্কায়ন যেমন বন্ধ ছিল, তেমনি রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণে ছিল জটিলতা। সেসঙ্গে কাস্টমস ছাড়পত্র না থাকায় পণ্যবাহী মাদার ভ্যাসেলের বন্দরের জেটিতে আসা কিংবা বন্দর ছাড়ও আটকে ছিল। ফলে ধর্মঘট প্রত্যাহার হলেও এর জের আরও কয়েক সপ্তাহ টানতে হবে বলে শঙ্কা ব্যবসায়ীদের। সব সংকটের কথা মাথায় নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের অতিরিক্ত চারগুণ স্টোর রেন্ট মওকুফ করার দাবি জানিয়েছেন তারা।
জানা যায়, রোববার (২৯ জুন) রাতেই সরকার একটি জরুরি নির্দেশনা জারি করে সব কাস্টমস ও কর বিভাগের কর্মকর্তাকে অবিলম্বে কাজে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দেয়।
নির্দেশনায় বলা হয়, তারা ‘অত্যাবশ্যক পরিসেবা’-এর অংশ, তাই কর্মবিরতি অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়। সরকারের কঠোর অবস্থানের পর কর্মকর্তারা পুনরায় নিজ নিজ দপ্তরে ফিরে আসেন। এর ফলে চট্টগ্রাম বন্দরসহ দেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থল ও নৌবন্দরে কার্যক্রম ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের কাস্টমস বিষয়ক সম্পাদক এএসএম রেজাউল করিম স্বপন জানান, স্বাভাবিক সময়ে আমদানি ও রপ্তানিপণ্য মিলে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৭ হাজার বিল অব এন্ট্রি ও বিল অব এক্সপোর্ট দাখিল হয় চট্টগ্রাম কাস্টমসে। কর্মকর্তাদের শাটডাউন কর্মসূচির কারণে রোববার সকাল থেকে কোনো ফাইলের কাজ হয়নি। কোনো শুল্কায়ন হয়নি। সন্ধ্যায় সিরিয়ালে ফাইলগুলোর কাজ শুরু করলেও আগের ফাইলও রয়ে যায়। যে কারণে ফাইলগুলোর শুল্কায়ন করতে দেরি হচ্ছে।
চট্টগ্রাম সিএন্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এসএম সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘কাস্টমস কর্মকর্তারা কাজে ফেরায় আমরা অনেকটাই চিন্তামুক্ত হয়েছি। বন্দরসহ চট্টগ্রামের ২১টি অফডকে কাজের গতি এসেছে। আশা করি, যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিল তা দুই-তিন দিনের মধ্যে নিরসন হবে। তবে এ বিষয়টি পুরোপুরি মীমাংসা করা প্রয়োজন, যেন পুনরায় দেশের রাজস্ব আহরণকারী খাত কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।’
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর এবং বহির্নোঙরে বর্তমানে ১২৯টি জাহাজ অবস্থান করছে। এর মধ্যে কনটেইনারবাহী ৩১টি জাহাজের মধ্যে ২১টি জাহাজ বন্দরের জেটিতে ভেড়ার অপেক্ষায় বহির্নোঙরে অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে শাটডাউনের দুই দিন।’
তিনি বলেন, ‘বহির্নোঙরে অবস্থানরত বাল্ক পণ্যবোঝাই অন্যান্য মাদার ভ্যাসেলকেও একই পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। অথচ নির্ধারিত সময়ের পর বন্দরে অবস্থানের কারণে মাদার ভ্যাসেলগুলো প্রতিদিন সর্বনিম্ন ১০ হাজার এবং সর্বোচ্চ ২৫ হাজার মার্কিন ডলার জরিমানা গুনতে হয়। জাহাজগুলো বার্থে বসে আছে। এতে বাড়ছে খরচ। পাশাপাশি জাহাজগুলোও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। সারা দেশের ব্যবসায়ীদের অন্তত হাজার কোটি টাকা লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে।’
বাংলাদেশ পেপার ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি মোহাম্মদ বেলাল বলেন, ‘পণ্য খালাস করতে গেলে এখানে আমরা অনেক আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মুখে পড়ি। ফলে পণ্য যথাসময়ে খালাস করতে পারি না। এখন পোর্ট ডেমারেজ চারগুণ করার কারণে ব্যবসায়ীদের ওপর অতিরিক্ত চাপ হয়ে গেছে। কাস্টমস কর্মকর্তাদের কর্মবিরতি পালনে আমাদের দোষ কি, শুল্কায়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। ফলে এটার জন্য পোর্ট ডেমারেজ দিতে হবে ব্যবসায়ীদের। তাই আমরা চারগুণ স্টোর রেন্ট বাতিল চাই। এটি আগের মতো করা হোক।’
বিজিএমইএর পরিচালক সাকীফ আহমেদ সালাম বলেন, ‘গত দুই দিন কাস্টমস কার্যক্রম বন্ধ থাকায় আমাদের পোশাক খাতে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। এই সময় অনেক পণ্য ডেলিভারি নেওয়া সম্ভব হয়নি, যার ফলে বন্দর এলাকায় কনটেইনার জমে গেছে এবং অতিরিক্ত ড্যামারেজ খরচ হয়েছে। আমরা সময়মতো পণ্য রপ্তানি করতে পারিনি, তাই অনেক বিদেশি ক্রেতা এখন এয়ার শিপমেন্ট বা ডিসকাউন্ট দাবি করতে পারে, যা আমাদের জন্য আর্থিকভাবে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টমসের উপকমিশনার সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘গতকাল রোববার রাত থেকে কাজ শুরু হয়েছে। সোমবার হাউসও খুলে গেছে। আমদানি-রপ্তানিসহ সব ধরনের কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলছে।’
বেসরকারি কনটেইনার ডিপো মালিকদের সংগঠন বিকডার মহাসচিব মোহাম্মদ রুহুল আমিন সিকদার বলেন, রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে কাস্টমস কর্মকর্তারা ডিপোগুলোতে কাজ শুরু করেছেন। বন্দরের যে তিনটি গেট দিয়ে ডিপোগুলোতে কনটেইনার আনা-নেওয়া হয় সেগুলোতে কাস্টমস কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করছেন।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, এনবিআরে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির মধ্যেও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সেবা বন্ধ ছিল না। বন্দরের ভেতরে আনস্টাফিং, গেটে যাচাই কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পয়েন্টে কাস্টমস কর্মকর্তারা উপস্থিত না থাকায় কনটেইনার ডেলিভারি প্রায় বন্ধ ছিল। ডিপোগুলোতে কাস্টমস কর্মকর্তারা উপস্থিত না থাকায় রপ্তানি কনটেইনারও বন্দরে পৌঁছাতে পারেনি। এনবিআর কর্মকর্তাদের কর্মসূচি প্রত্যাহারের পর তারা কাজে যোগ দিয়েছেন। সোমবার সকাল থেকে পুরোদমে বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পণ্য খালাস, জাহাজীকরণ শুরু হয়েছে। আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
প্রসঙ্গত, এক অধ্যাদেশে সরকার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভেঙে পৃথক দুটি বিভাগ গঠনের উদ্যোগ নেয়। কর্মকর্তারা এই সিদ্ধান্তকে প্রশাসনিক কাঠামো ও কার্যকারিতার ওপর সরাসরি আঘাত বলে মনে করছেন। তাদের দাবি- এনবিআর বিলুপ্তির সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে, এনবিআর চেয়ারম্যানকে পদত্যাগ করতে হবে এবং ট্যাক্স প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
আর্কাইভ 
| ০১ জুলাই ২০২৫ 
