যাত্রী পারাপারে নেই কোনো অনুমোদন। নেই পরিবহনের ফিটনেস সনদ। ঘাট থেকে যাত্রী পরিবহনে নেই নিয়ন্ত্রণ। যে যার মতো করে যাত্রী পারাপার করছে। বোট মালিকরা সিন্ডিকেটের মাধ্যম নিরাপত্তার কথা চিন্তা না করে বহন করছে অতিরিক্ত যাত্রীও। নিরুপায় হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসব ফিটনেসবিহীন স্পিডবোটে মেঘনা পাড়ি দিতে হচ্ছে নোয়াখালী হাতিয়ার নলচিরা-চেয়ারম্যান ঘাট রুটে চলাচলকারী হাজার হাজার যাত্রীকে। এতে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা।
উপজেলার বিভিন্ন এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাতিয়া বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হওয়ায় এখানকার যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হলো নদীপথ। এর মধ্যে চট্টগ্রাম-হাতিয়া, ঢাকা-হাতিয়া ও নলচিরা-চেয়ারম্যান ঘাট রুটে অধিকাংশ মানুষ নদীপথে যাতায়াত করেন। তবে জেলা সদরসহ সড়কপথে যাওয়ার জন্য দ্বীপের মানুষজনকে নলচিরা-চেয়ারম্যান ঘাট রুটে চলাচল করতে হয়। প্রতিদিন এই রুটে ৬-৭ হাজার মানুষ আসা যাওয়া করে।
এসব যাত্রীর জন্য নিরাপদ ও সরকারি বাহন হচ্ছে একটিমাত্র সি-ট্রাক। কিন্তু দ্রুত চলাচলের জন্য এই রুটে ব্যক্তিমালিকানা স্পিডবোট রয়েছে। সিন্ডিকেটের মাধ্যম অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন ও ত্রুটিপূর্ণ ফিটনেসবিহীন বোট চালিয়ে যাচ্ছেন। এসব অনিয়ম রোধে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো কার্যক্রম দেখা যায় না বলে অভিযোগ। একবার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হলেও অনিয়ম রোধ করা যায়নি। সিন্ডিকেটের দাপটে প্রশাসন যেন নির্বিকার।
মোক্তাদির রাহিম জনি নামে একজন গত ২৩ জুন বোনকে নিয়ে বাড়ি আসতে ওঠেন যাত্রীবাহী স্পিডবোটে। তিনি জানান, বোটটি ধারণক্ষমতার বাইরেও ২৮ জন যাত্রী নিয়ে রওনা হয়। মাঝনদীতে হঠাৎ বোটের তলা ফেটে পানি ঢুকে দেখা দেয় ইঞ্জিনের ত্রুটি। জীবন বাঁচাতে যাত্রীরা নিজেদের জামা-কাপড় দিয়ে ভাঙা অংশ চেপে ধরেন। উপায় না পেয়ে চালক স্রোতের দিকে চালিয়ে বোটটিকে ঘাটের অনেক দূরে তীরের কাছাকাছি নিয়ে আসেন। এতে প্রাণে বাঁচলেও খোয়া যায় অনেকের ব্যাগসহ মূল্যবান জিনিসপত্র।
মোক্তাদির রাহিম জনি বলেন, এ ঘটনার পর তীরে উঠে প্রাণে বেঁচে যাওয়া যাত্রীরা ক্ষুব্ধ হয়ে চালকের কাছ থেকে বোটের মালিকের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে কল দেন। অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন ও ত্রুটিপূর্ণ বোটে যাত্রীবহনের কারণ জানতে চাইলে উত্তেজিত হয়ে যান বোটের মালিক। এ সময় মালিক মোবাইলে যাত্রীদের হুমকি দিতেও শোনা যায়। অতিরিক্ত যাত্রী বহন নিজেদের ত্রুটির কারণে এতবড় একটি দুর্ঘটনা থেকে বাঁচা যাত্রীদের সঙ্গে কোনো সহমর্মিতা দেখাননি ওই মালিক।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডুবে যাওয়া স্পিডবোটের মালিক মো. পিটু। মাছ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকলেও রয়েছে তার আরও ব্যবসা। উপজেলা বিএনপির সাবেক সহসাংগঠনিক সম্পাদক হাসান ইমাম তার ব্যবসায়ীক অংশীদার। এজন্য ন্যায় অন্যায় কোনো কিছুতে তোয়াক্কা করেন না তিনি। তবে স্পিডবোটটির মালিক মো. পিটু যাত্রীদের সঙ্গে উত্তেজিত আচরণ করার কথা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ঘটনাটি নিছকই একটি দুর্ঘটনা ছিল। অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনের বিষয়টি চালক আমাকে জানাননি।
একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরির সুবাদে প্রায় এই রুটে আসা-যাওয়া করা নুর উদ্দিন জানান, গত মাসের শেষের দিকে নলচিরা থেকে ২২ জন যাত্রী নিয়ে একটি স্পিডবোট রওনা হয় চেয়ারম্যান ঘাটের উদ্দেশে। কিছুদূর যাওয়ার পর ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। নদীতে ভাসতে থাকে বোটটি। সামনে অন্ধকার নেমে আসছে। যাত্রীদের মধ্যে হতাশা বেড়ে যায়। বারবার ফোন দেওয়ার পরও মালিক ফোন রিসিভ করছেন না। পরে ঘাটে ফোন দিয়ে অন্য একটি বোট এনে যাত্রীদের ঘাটে পৌঁছে দেওয়া হয়।
হাতিয়ার নলচিরা-চেয়ারম্যান ঘাট রুটে যাত্রী পারাপারে ৭০টির মতো স্পিডবোট রয়েছে। ৫ আগস্ট ক্ষমতা বদলের পর যে যার মতো করে এসব বোট নামিয়েছেন যাত্রী পরিবহনে। সেগুলোর অধিকাংশের নেই ফিটনেস। নেই অনুমোদন। ঘাট থেকে যাত্রী ওঠানামায় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলছে এগুলো। ঘাটে থাকা একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, এসব স্পিডবোটে যাত্রী পরিবহনে সিরিয়াল দেওয়ার জন্য দুই ঘাটে লাইনম্যান নিয়োগ করা আছে। তারা প্রতিটি বোট থেকে প্রতি ট্রিপের জন্য ১০০ টাকা করে নেন। তাদের মধ্যে আছে আবার ভিন্ন সিন্ডিকেট। অর্থের বিনিময়ে তারা ফিটনেসবিহীন বোট সিরিয়াল দিতে সহযোগিতা করে। অনেক সময় অতিরিক্ত যাত্রী বহনে চালকদের সঙ্গে তাদের সখ্য থাকে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এই রুটে চলাচলকারী ৭০টি স্পিডবোটের মধ্যে ১৮-২০টির ফিটনেস সনদ রয়েছে। অন্যগুলোর ইঞ্জিন থেকে বডি অনেক বড়। কিছু বোটের ইঞ্জিন বারবার বিকল হয়ে যায়। অনেক সময় এসব বোট যাত্রী নেওয়ার পর দেখা যায় আর ইঞ্জিন চালু হচ্ছে না। যাত্রী নিয়ে মাঝনদীতে বিকল হয়ে পড়ার নজির নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
যাত্রীদের অভিযোগ ও প্রশাসনের হস্তক্ষেপের কারণে সম্প্রতি বোট মালিকরা হাতিয়া স্পিডবোট মালিক সমিতি নামে একটি সংগঠন করে। এতে সভাপতি করা হয় জাকের হোসেন কালু নামে একজনকে। তিনি বলেন, নতুন কমিটির কাছে এখনো সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আসেনি। ঘাটের লাইনম্যানরা আগে থেকেই বেপোরায়া। তারা কারও কথা শোনে না।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আলাউদ্দিন বলেন, অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন এবং এই রুটে ফিটনেসবিহীন পরিবহনে যাত্রীদের প্রতিনিয়ত ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে। সম্প্রতি একটি বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেছেন ২৮ যাত্রী। অবৈধ স্পিডবোট চলাচল বন্ধ করতে আমরা নৌ পুলিশ ও কোস্টগার্ডের সমন্বয়ে একটি টিম গঠন করব। তারা কোন স্পিডবোট চলবে, কোনটা চলবে না, আবার কোনটায় কতজন যাত্রী বহন করতে পারবে, এসব ঠিক করে দেবে।
মন্তব্য করুন