নওগাঁর বদলগাছী মহিলা ডিগ্রি কলেজে অধ্যক্ষের চেয়ার নিয়ে এখনো টানাটানি চলছে দুই শিক্ষকের মধ্যে। চেয়ারের এই দাবিদার নিয়ে শিক্ষকদের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। এতে কলেজজুড়ে দেখা দিয়েছে জটিলতা। যার খেসারত দিতে হচ্ছে ওই কলেজ শিক্ষার্থীদের।
এদিকে জীবননাশসহ বিভিন্নভাবে হুমকি-ধমকি পাচ্ছেন বলে অভিযোগ করে এবং নিজেকে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দাবি করে সংবাদ সম্মেলন করেছেন ওই কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো. ইমামুল হোসেন। অপরদিকে নিজেকে বৈধ অধ্যক্ষ দাবি করছেন মাহবুব আলম।
রোববার (৬ জুলাই) দুপুরে নওগাঁ জেলা প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করেন সহকারী অধ্যাপক ইমামুল হোসেন।
অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে ইমামুল হোসেন অভিযোগ করে বলেন, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে অধ্যক্ষের পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত মাহবুব আলম নিজেকে এখনও অধ্যক্ষ হিসেবে দাবি করে তাকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালনে নানাভাবে বাধা দিচ্ছেন। এমনকি অধ্যক্ষের কার্যালয়ে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাকে শারীরিক নির্যাতন ও লাঞ্চিত করা হয়েছে।
ইমামুল হোসেন বলেন, বদলগাছী মহিলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরী ২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর অবসর গ্রহণ করলে কলেজ পরিচালনা কমিটির তৎকালীন সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ছলিম উদ্দিন তরফদার কলেজের জ্যেষ্ঠতার ক্রমানুসারে ১৩ম প্রভাষক মাহবুব আলমকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করেন। জ্যেষ্ঠতার বিধি লঙ্ঘন করে তাকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, পরবর্তীতে ২০২২ সালের ১৯ অক্টোবর নিয়োগ বিধি অনুযায়ী তিন বছরের সহকারী অধ্যাপকসহ ১৫ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও জাল-জালিয়াতি করে মাহবুব আলমকে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। অভিজ্ঞতা সনদ জালিয়াতি ও জ্যেষ্ঠতার বিধি লঙ্ঘণ করে মাহবুব আলমকে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার ঘটনায় লিখিত অভিযোগ করা হলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) মাহবুব আলমকে ২০২৪ সালের ১৭ মে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়। কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় একই বছর ৩ জুলাই অধ্যক্ষ মাহবুব আলমের বেতন বন্ধের আদেশ দেন মাউশি, যা অদ্যাবধি কার্যকর আছে।
লিখিত বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, ২০২৪ এর ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রজ্ঞাপনের আলোকে পূর্বের কমিটি বাতিল হয় এবং পরবর্তী প্রজ্ঞাপনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসেবে নিযুক্ত হন। অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে ওই বছরের ২৭ আগস্ট কলেজ পরিচালনা কমিটি মাহবুব আলমকে সাময়িক বরখাস্ত করেন এবং কলেজের সহকারী অধ্যাপক মমতাজ জাহানকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেন। মমতাজ জাহান কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করা অবস্থায় গত ৭ মে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিধি বহির্ভূতভাবে ফজলে হুদা বাবুলকে কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসেবে মনোনয়ন দেন। ফজলে হুদা দায়িত্ব পেয়েই মাহবুবল আলমকে অধ্যক্ষ পদে যোগদান করান।
তিনি বলেন, পরবর্তীতে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মমতাজ জাহানের ওপর মাহবুব আলম ও কলেজ কমিটির সভাপতি বিভিন্নভাবে মানসিক চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। গত ৮ মে তালা ভেঙে মাহবুব আলম অধ্যক্ষ কক্ষে প্রবেশ করেন এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্রাদিসহ লক্ষাধিক টাকা লুট করেন। এ ঘটনার পর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মমতাজ জাহান দায়িত্বপ্রাপ্ত সভাপতি ফজলে হুদার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন। গত ২ জুন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই আদেশকে তিন মাসের জন্য স্থগিত করে রায় দেন হাইকোর্ট। এই রায়ের ফলে পূর্বের কমিটির সভাপতি লুৎফর রহমান আবারও স্বপদে ফিরে আসেন।
আরও বলেন, এদিকে গত ৭ জুন ভারপ্তাপ্ত অধ্যক্ষ মমতাজ জাহান মারা যান। মমতাজ জাহানের মৃত্যুর পর গত ২৫ জুন মাহবুব আলমের অধ্যক্ষ পদে পুনর্বহালের আদেশটি বাতিল করে কলেজের সহকারী অধ্যাপক ইমামুল হোসেনকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেন কলেজ পরিচালনা কমিটির বর্তমান সভাপতি লুৎফর রহমান।
ইমামুল ইসলাম বলেন, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর গত ২৯ জুন তিনি অধ্যক্ষের কার্যালয়ে গেলে সাময়িক বরখাস্ত অধ্যক্ষ মাহবুব আলম, কলেজের প্রভাষক মেহেদী হাসান, আজাদ হোসেনসহ অজ্ঞাতনামা বেশ কয়েকজন তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন ও লাঞ্ছিত করেন। এ ঘটনায় থানায় মামলা করতে গেলে থানা মামলা নেননি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে গিয়েও তিনি কোনো প্রতিকার পাননি। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মাহবুব আলম ও তার লোকজন ইমামুলকে জীবননাশসহ বিভিন্নভাবে হুমকি-ধামকি দিয়ে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় তিনি চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে অভিযোগ করেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মাহবুব আলম বলেন, আমি বদলগাছী মহিলা ডিগ্রি কলেজের বৈধ অধ্যক্ষ। ৫ আগস্টের পর মব সৃষ্টি করে আমাকে জোরপূর্বক পদত্যাগ করানো হয়। জোরপূর্বক পদত্যাগ বিধিসম্মত নয় বলে পরবর্তীতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে। এছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় জনাব ফজলে হুদাকে বিধি মোতাবেক কলেজ পরিচালনা এ্যাডহক কমিটির সভাপতি হিসেবে অনুমোদন দিয়েছেন। এই এ্যাডহক কমিটির সভাপতি ও তার পরিষদ সর্বসম্মতিক্রমে আমাকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী পুনরায় অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দিয়েছেন। বর্তমান এ্যাডহক কমিটি স্থগিত করা হয়েছে এমন পরিপত্র বা আদেশ তারা দেখাতে পারেননি। তারা শুধু হাইকোর্টের রিট করেছেন এবং হাইকোর্ট এই কমিটির ওপর তিনি মাসের জন্য স্থগিতাদেশ এবং তিন সপ্তাহের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশের আদেশের কথা বলছেন। রিট শুনানি না হতেই আগের কমিটি কিভাবে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগ দিতে পারে?
ইমামুল হোসেনকে দায়িত্বগ্রহণে বাধা এবং শারিরীকভাবে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ইমামুল হোসনকে কোনো প্রকার শারিরীকভাবে নির্যাতনের অভিযোগ করা হয়নি। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং বানোয়াট।
উল্লেখ, গত রোববার (২৯ জুন) কলেজে দুই গ্রুপের অধ্যক্ষের চেয়ার দখল নিয়ে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। ঘড়ির কাটায় দুপুর ১টা। এইচএসএসি পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা শেষ করে খাতা জমা দিচ্ছে। এমন সময় ইমামুল হোসেন নিজেকে অধ্যক্ষ দাবি করে অধ্যক্ষ মাহবুব আলমের পাশের চেয়ারে বসে পড়ে। ঠিক তখনই দুই পক্ষের শিক্ষকদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। মুহূর্তেই রূপ নেয় হাতাহাতিতে। এরপর অধ্যক্ষ পদে দুজনই দাবি করে চেয়ারে বসেন।
বর্তমানে চেয়ারের এই টানাটানি নিয়ে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে। কলেজ পরিচালনা ও নিয়োগে বিষয়টি এখন হাইকোর্টে বিচারাধীন এবং তিন মাসের জন্য নিয়োগাদেশ স্থগিত রয়েছে।
মন্তব্য করুন