সাতক্ষীরা-০৩ আসনের নতুন সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে নির্বাচন কমিশন এ সীমানা নির্ধারণ করলেও বাস্তবায়ন অসম্ভব বলে মনে করছেন ভোটাররা। ভৌগোলিক কারণেও এটি বাস্তবায়ন অসম্ভব।
নতুন নির্ধারণ করা সীমানার স্থল পথে নেই কোন যোগাযোগ ব্যবস্থা। দুই উপজেলা তিন পাশ নদী পরিবেষ্টিত। প্রতি বছরই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত। তবুও খাতা-কলমে জুড়ে দেওয়া হয়েছে দুটি উপজেলাকে। নতুন সীমানা নির্ধারণের সময় এমনটাই করা হয়েছে সাতক্ষীরা-০৩ সংসদীয় আসনের ক্ষেত্রে।
চলতি বছরের ৩০ জুলাই বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন সচিবালয় সংসদীয় আসন বিন্যাসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর থেকে এ নিয়ে আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলার রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে ক্ষোভের। আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলাকে একীভূত করে একটি আসন করায় দুই উপজেলায় পুনরায় সীমানা নির্ধারণ করার দাবিতে পৃথক পৃথকভাবে পালন করা হচ্ছে নানা কর্মসূচি। বিক্ষোভ মিছিল, প্রতিবাদ সমাবেশ, স্মারকলিপি প্রদানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। পুনরায় আসনের সীমানা নির্ধারণের জন্য ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন বরাবর রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তির পক্ষ থেকে জমা দেওয়া হয়েছে অভিযোগ।
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে জমাকৃত অভিযোগ, স্থানীয় দুই উপজেলার রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও সাধারণত মানুষের সঙ্গে আলাপ থেকে জানা গেছে, সাতক্ষীরা জেলার দক্ষিণাংশের আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে ২০০৮ সালের আগ পর্যন্ত ২টি আসন ছিল। সংসদীয় এলাকা (সাতক্ষীরা-০৩) শুধু আশাশুনি উপজেলা নিয়ে গঠিত ছিল। অপরটির সংসদীয় এলাকা (সাতক্ষীরা-০৫) যেটা ছিল শুধু শ্যামনগর উপজেলা নিয়ে গঠিত। যা ছিল ভৌগোলিকভাবে দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা ও দুর্যোগপূর্ণ উপকূলীয় এলাকা বিবেচনায় গৃহীত সিদ্ধান্ত।
এরপর বিগত সরকারের আমলে জামায়াত ও বিএনপির বেজ এলাকা বাছাই করে শুধু ভোটার সংখ্যার বিবেচনায় বেশ কিছু সংসদীয় এলাকায় আসন কমিয়ে আওয়ামী লীগের সুবিধা দিতে ঢাকাসহ আরও কিছু জায়গায় আসন বৃদ্ধি করা হয়। তারই অংশ হিসেবে সাতক্ষীরা ০৩ ও ০৪ আসনের সীমানা নির্ধারণের নামে ভেঙে নতুন আসন গঠন করা হয়। কালীগঞ্জ ও দেবহাটা নিয়ে গঠিত আসন বিলুপ্ত করা হয়। দেবহাটা সম্পূর্ণ ও কালিগঞ্জের চারটি ইউনিয়ন আশাশুনি উপজেলার সঙ্গে জুড়ে দিয়ে করা হয় সাতক্ষীরা-০৩ আসন। কালীগঞ্জের বাকি ইউনিয়ন জুড়ে দেওয়া হয় সাতক্ষীরা-০৪ আসন তথা শ্যামনগরের সঙ্গে। যে কারণে সাতক্ষীরা জেলা হারায় একটি সংসদীয় আসন। কিন্তু এবার আশাশুনি ও শ্যামনগরকে ১টি মাত্র সংসদীয় এলাকা (সাতক্ষীরা-০৪ আসন) করায় বিষয়টি সমাধান না করে আরও জটিল হয়েছে। কারণ ভৌগোলিক দিক থেকে আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলা অনেক বিস্তৃত ও নদীবহুল অঞ্চল।
আশাশুনি উপজেলা যেমন নদী দিয়ে চার খণ্ডে বিভক্ত তেমনি শ্যামনগর তিন খণ্ডে বিভক্ত এবং দেশের সবচেয়ে বড় উপজেলা। তাছাড়া আশাশুনির সঙ্গে শ্যামনগরের সরাসরি কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই। দুটি উপজেলারই যোগাযোগ ব্যবস্থা অন্যান্য উপজেলার তুলনায় অনেক দুর্গম ও নাজুক।
স্থানীয় সব মহলের দাবি, প্রতি বছর আশাশুনির বেতনা, মরিচ্চাপ, গলঘেষিয়া, কপোতাক্ষ ও খোলপেটুয়া নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে কোনো না কোনো এলাকা প্লাবিত হয়। তদ্রুপ শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, পাতাখালী, পাখিমারাসহ বিভিন্ন পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। দুর্যোগকালীন একজন সংসদ সদস্যের পক্ষে যা তদারকি করা দুরূহ ব্যাপার। এই বিশাল এলাকার প্রায় ১০ লক্ষাধিক জনগোষ্ঠী নিয়ে নির্বাচন করা একজন সংসদ সদস্যের পক্ষে কষ্টসাধ্য। যার ফলে উন্নয়ন, নদী ভাঙনসহ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার কার্যকর তদারকি করা সম্ভব নয় এবং এতে প্রশাসনিক জটিলতা তৈরির চরম সম্ভবনা সুনিশ্চিত। তাই শুধু ভোটার সংখ্যা বিবেচনায় না নিয়ে ভৌগোলিক অবস্থান, দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা ও উপকূলীয় এলাকা হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে আশাশুনি উপজেলা ও শ্যামনগর উপজেলাকে পূর্বের মতো দুটি সংসদীয় আসন করাসহ বাকি আসনগুলো পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা জরুরি।
দুই উপজেলার সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কথা বিবেচনা করে প্রধান নির্বাচন কমিশনের সচিবালয়ের উল্লেখিত ৩০ জুলাইয়ের বিজ্ঞপ্তির ঘোর আপত্তি করছেন এই দুই উপজেলার সর্বমহল। পাশাপাশি কমিশনের নতুন সিদ্ধান্ত বাতিল পূর্বক জনস্বার্থে আগের মত আশাশুনি উপজেলাকে একটি সংসদীয় আসন-১০৭ (সাতক্ষীরা-০৩) ঘোষণার জোর দাবি জানানো হয়েছে নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা বিভিন্ন আবেদনে।
এ বিষয়ে আশাশুনি উপজেলা বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব মশিউল হুদা তুহিন বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে আশাশুনি ও শ্যামনগর পৃথক সংসদীয় আসন। এই দুটি উপজেলার মধ্যে নেই কোনো স্থল সীমান্ত। নির্বাচন কমিশনের এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত আমরা দুই উপজেলার কেউ মানতে পারছি না। আমাদের একটাই দাবি- আশাশুনি ও শ্যামনগর পৃথক পৃথক সংসদীয় আসন করা হোক।
সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ সম্পর্কে কেন্দ্রীয় কৃষক দলের নেতা গাজী আমিনুর রহমান মিনু বলেন, আশাশুনি ও শ্যামনগর দুটি উপজেলায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ কবলিত উপজেলা। ভৌগোলিকভাবে এই দুটি উপজেলার সড়ক পথে কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন গত ৩০ জুলাই নতুন সীমানা নির্ধারণে যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে তা বাস্তবে অবাস্তব। কাগজে-কলমে সম্ভব হলেও বাস্তবে অসম্ভব। সে কারণে অনতিবিলম্বে দুটি উপজেলাকে পৃথক করে আগের মতো দুটি আসন করার দাবি জানান তিনি।
আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলাকে পৃথক দুটি আসন করার দাবি জানিয়ে উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ও সাবেক সংসদ সদস্য মাওলানা রেয়াছাদ আলীর ছেলে মাওলানা নুরুল আবছার মুর্তাজা বলেন, মানুষের ভালোমন্দ দেখাশোনার জন্য এমপি নির্বাচিত হয়। কিন্তু আশাশুনি ও শ্যামনগর মিলে একটা সংসদীয় আসন হলে একজন এমপি হবে। সেক্ষেত্রে দুটো দুর্যোগপ্রবণ উপজেলা এক করে সংসদীয় আসন করা হলে নির্বাচিত এমপির পক্ষে জনগণের দেখভাল অসম্ভব হয়ে পড়বে।
আশাশুনি উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির আবু মুছা তারিকুজ্জামান তুষার বলেন, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় কর্তৃক গত ৩০ জুলাই প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তির পর আমরা যখন জানতে পারলাম শ্যামনগর ও আশাশুনি মিলে একটি আসন করা হচ্ছে। এরপর থেকে আমরাসহ শ্যামনগর উপজেলার ভোটাররা এ বিষয়ে তীব্র বিরোধিতা করে আসছি। ইতোমধ্যে উভয় উপজেলার সাধারণ মানুষের দাবির পক্ষে পুনরায় সীমানা নির্ধারণ করার জন্য অর্থাৎ আশাশুনি এবং শ্যামনগরকে পৃথক দুটি আসন করার জন্য নির্বাচন কমিশন বরাবর স্মারকলিপিসহ অভিযোগ প্রেরণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, যদি কমিশনের পক্ষে চারটি আসনের অধিক করা সম্ভব না হয় সেক্ষেত্রে কালিগঞ্জ উপজেলাকে শ্যামনগরের সঙ্গে এবং দেবহাটা উপজেলাকে আশাশুনির সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। কিন্তু শ্যামনগরের সঙ্গে আশাশুনি কখনো সম্ভব নয়, এটি একটি অবাস্তব কল্পনা বলেও দাবি করেন তিনি।
মন্তব্য করুন