খুলনা ব্যুরো
প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৬:৩২ পিএম
আপডেট : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৬:৪৯ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

আতঙ্কের নগরী খুলনা, ২৪ ঘণ্টায় উদ্ধার ৪ মরদেহ

ছবি : কালবেলা গ্রাফিক্স
ছবি : কালবেলা গ্রাফিক্স

খুলনায় নিয়মিত হত্যা, মরদেহ উদ্ধার, আধিপত্য বিস্তার ও মৃত্যুসহ একাধিক ঘটনায় আতঙ্কিত নগরবাসী। নগরীতে একের পর এক অপরাধ ঘটলেও ধরা পড়ছে না প্রকৃত সন্ত্রাসীরা। সব সময়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে তারা।

আগে যে নগরীর সকাল শুরু হতো কর্মমুখী মানুষের কোলাহলে, এখন সেই নগরীর সন্ধ্যা ঢেকে যায় আতঙ্কে। রক্তের দাগ ও লাশের খবরে শান্ত শহর পরিণত হয়েছে অচেনা নগরীতে। খুন, ছিনতাই আর লাশ উদ্ধারের গল্পে খুলনা হারিয়েছে স্বস্তির নিঃশ্বাস।

খুলনায় গত ২৪ ঘণ্টায় চারজনের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর) থেকে মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর) সকাল পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন এলাকা থেকে তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে খুলনা রেল স্টেশনের প্লাটফর্ম থেকে প্রিন্স নামে এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

রেলওয়ের নিরাপত্তা বাহিনীর হাবিলদার ওহিদ খান বলেন, ‘স্টেশনের প্লাটফর্ম থেকে যে যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে তার বয়স আনুমানিক ২৫ বছর। তিনি স্টেশন সংলগ্ন একটি হোটেলের কর্মচারী ছিলেন।’

সোমবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে রূপসা উপজেলার জাবুসা চৌরাস্তা এলাকায় সড়কের পাশে বিল থেকে এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

রূপসা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘৯৯৯ এর মাধ্যমে বিলে একটি মরদেহ ভাসছে খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। সেখান থেকে অজ্ঞাত ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করা হয়। কিভাবে তিনি মারা গেছেন ও পরিচয় শনাক্তের জন্য পুলিশ কাজ করছে। ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।’

সোমবার এ ঘটনার কিছু সময় আগে রাত সাড়ে ৭টার দিকে নগরীর লবণচরা এলাকায় খুলনা-মোংলা মহাসড়কের পাশ থেকে এক অজ্ঞাতপরিচয় বৃদ্ধের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

লবণচরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাওলাদার সানওয়ার হুসাইন মাসুম বলেন, ‘থানা থেকে খানজাহান আলী সেতুর দিকে যাওয়ার পথে মহাসড়কের পাশে সিটি করপোরেশনের ফেলা মাটির উপরে ওই বৃদ্ধ পড়েছিলেন। মৃতের বয়স আনুমানিক ৮০ বছর।’

এর আগে, খুলনার বটিয়াঘাটায় পুকুরে পড়ে জোসনা কুণ্ডু (৭৭) নামে এক বৃদ্ধার মৃত্যু হয়। রোববার রাতে পুকুরে থালাবাটি পরিষ্কারের সময় পুকুরে পড়ে তিনি যান। রাতের মাঝামাঝি সময়ে তার মরদেহ ভেসে ওঠে।

বটিয়াঘাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আব্দুর রহিম বলেন, ‘জোসনা কুণ্ডু শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। রোববার রাতে তিনি বাড়ির সামনের পুকুরে থালা বাটি পরিষ্কার করছিলেন। এ সময় বাড়িতে কেউ ছিল না। পরিবারের সদস্যরা বাড়িতে ফিরে তাকে না পেয়ে চারিদিকে খুঁজতে থাকেন। বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করেও না পেয়ে একপর্যায়ে পুকুরে ভাসমান দেখতে পেয়ে স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়িতে খবর দিলে পুলিশ গিয়ে মরদেহ উদ্ধার করে। সোমবার সকালে মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।’

এর আগে, রোববার (২৮ সেপ্টেম্বর) গভীর রাতে খুলনা নগরীর শিপইয়ার্ড সড়কের হাজি মালেক কলেজ এলাকায় এক ছিনতাইকারীকে আরেক ছিনতাইকারী গুলি করেছে। গুলিবিদ্ধ যুবকের নাম- মো. মুন্না ওরফে কাটিং মুন্না। তিনি লবণচরা থানাধীন চানমারি খ্রিস্টানপাড়া এলাকার বাসিন্দা সাগরের ছেলে। তার নামে খুলনার লবণচরা থানাসহ একাধিক থানায় মামলা রয়েছে।

জানা গেছে, মুন্না রোববার রাতে নগরীর হাজি মালেক কলেজ এলাকায় ছিনতাই করেছে। পরে রাত সাড়ে ১২টার দিকে অপর গ্রুপের ছিনতাইকারী সদস্যরা তাকে ধরে নিয়ে যায় এবং হত্যার উদ্দেশ্যে পরপর কয়েকটি গুলি চালায়। এ ঘটনায় তার পায়ে দুটি গুলি লাগে। তাকে উদ্ধার করে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সম্প্রতি খুলনায় উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে নদ-নদীতে মরদেহ উদ্ধারের ঘটনা। গত এক বছরে খুলনায় নদী থেকে অন্তত ৫০টি মরদেহ উদ্ধার করেছে নৌ-পুলিশ। অজ্ঞাত এসব মরদেহের পরিচয় শনাক্ত করতে ব্যর্থ পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো, যা বাড়াচ্ছে জনমনে আতঙ্ক। ঘন ঘন মরদেহ উদ্ধারের এ প্রবণতায় স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতি সামাল দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা আরও বাড়ানোর দাবি তুলেছেন স্থানীয়রা।

খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত অষ্টম মাসে খুলনা মহানগরে খুনের ঘটনা ঘটেছে ১৮টি। আর গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত ৩১টি হত্যা মামলা রুজু হয়েছে। এই ৩১টি হত্যা মামলায় পুলিশ ১৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করলেও প্রকৃত অপরাধীরা এখনো অনেকাংশেই ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর চলতি বছরে ১৮টি মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছে ৬৯ জন। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত একই সময়ে হত্যা মামলার সংখ্যা ছিল ১৯।

এদিকে, হঠাৎ খুলনা মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় বেড়ে গেছে বিদ্যুতের সার্ভিস তার চুরির ঘটনা। লোডশেডিংয়ের সুযোগে, আবার কখনও বিদ্যুৎ চালু থাকা অবস্থাতেই সংঘবদ্ধ চক্র কৌশলে এই তার কেটে নিয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত যে কোনো সময় ঘটছে এসব ঘটনা। এতে নগরবাসীর মধ্যে দেখা দিয়েছে চরম উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা।

রবিবার সন্ধ্যায় নগরীর ইকবালনগর মসজিদ লেনে কয়েক মিনিটের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকলে এ সুযোগে খুলনার আঞ্চলিক পত্রিকা দৈনিক পূর্বাঞ্চল কার্যালয়ের সামনের একটি ভবনের সার্ভিস তার কেটে নেয় একদল চোর। বিদ্যুৎ ফিরে আসার পরও সংশ্লিষ্ট ভবনে বিদ্যুৎ না থাকায় বাসিন্দারা বিষয়টি বিদ্যুৎ অফিসে জানান। পরে কর্মকর্তারা এসে সার্ভিস তার চুরির ঘটনা শনাক্ত করেন।

এর আগে সোনাডাঙ্গা মডেল থানাধীন হাফিজনগর এলাকার ময়ূর নদী সংলগ্ন দুটি বাড়ি থেকেও একইভাবে সার্ভিস তার চুরির ঘটনা ঘটে। রাতের বেলায় বিদ্যুৎ চলে গেলে প্রথমে বাসিন্দারা লোডশেডিং ভেবে নিলেও দীর্ঘ সময় পরও বিদ্যুৎ না ফেরায় সন্দেহ হয়। সকালে দেখা যায়, চোরেরা সার্ভিস তার কেটে নিয়ে গেছে। দুর্গাপূজা উপলক্ষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল জোরদার থাকলেও চক্রটি যে সংঘবদ্ধভাবে এ ধরনের অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে।

বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, এক শ্রেণির নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি এসব সার্ভিস তার চুরি করে বিক্রি করছে। তবে কোথায় এগুলো বিক্রি হচ্ছে তা শনাক্ত করতে পারলেই মূল চক্রকে ধরা সম্ভব বলে মন্তব্য করেন তারা। সূত্র বলছে, নগরীর শেখপাড়ার পুরনো তার বিক্রির দোকানগুলোতে এসব তার বিক্রি হয়।

এসব ঘটনায় বেশির ভাগই আসামি গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে। আর গ্রেপ্তার হলেও আসামিরা আদালতের মাধ্যমে জামিনে বের হয়ে আবারও একই ধরনের অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।

খুলনার নাগরিক সমাজের সদস্যসচিব অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার বলেন, ‘খুলনায় চলমান অপরাধের পেছনে আধিপত্য বিস্তার, পূর্ববিরোধ, মাদকসংশ্লিষ্টতা ও রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ার বিষয়গুলো বড় ভূমিকা রাখছে। অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছি।’

তিনি বলেন, ‘খুলনার পুলিশ প্রশাসন আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনতে এখন চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। সাধারণ মানুষ হিসেবে এমন অবস্থা কাম্য নয়।’

খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী কমিশনার (মিডিয়া) খন্দকার হোসেন আহমদ বলেন, ‘খুলনাবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে আমরা টহল বাড়িয়েছি, বিশেষ চেকপোস্ট দিয়েছি শহরের বিভিন্ন জায়গায়। আমরা প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের অল্প সময়ের মধ্যেই গ্রেপ্তার করেছি। আমরাও বিষয়গুলো নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছি। নগরীর আইনশৃঙ্খলার উন্নয়নে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আইফোনের নতুন মডেলে যেসব ত্রুটির অভিযোগ তুললেন ব্যবহারকারীরা

ঐশ্বরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে মুখ খুললেন বিবেক

দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরিতে ষড়যন্ত্র করছে একটি চক্র : জুয়েল

ট্রাম্প কি আবারও ফিলিস্তিনিদের জন্য ফাঁদ পাতলেন?

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত আলভী, দোয়া চাইলেন ভক্তদের

চিকিৎসার নামে প্রতারণা / জিন দিয়ে ‘অপারেশন’, ইনজেকশন হয় আঙুল দিয়ে

নিজের পাসপোর্টে সৃজিতের নাম আছে কি না, যা বলছেন মিথিলা

 বিএনপির স্বাস্থ্য সম্পাদক ডা. রফিক দুর্ঘটনার শিকার

সাতক্ষীরায় জেডএসআরএমের মতবিনিময় সভা

ধর্ম নিয়ে বক্তব্য, যুবশক্তির তারিকুলের দুঃখ প্রকাশ

১০

এবার ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটে পেট্রো ডলার নিয়ে সৌদি আরবের আগমন

১১

আ.লীগ দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরিতে লিপ্ত : জুয়েল

১২

শাপলা প্রতীক না পাওয়ায় ইসিকে সারজিসের বার্তা

১৩

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সম্মত যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টি

১৪

ফেসবুকে নতুন ফিচার চালু করল মেটা, ব্যবহারে উপকার কী জেনে নিন

১৫

বিএসটিআই অনুমোদন ছাড়াই দই-মিষ্টি বিক্রি, জরিমানা

১৬

‘ফাতাহ-৪’ ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ল পাকিস্তান

১৭

জিডিতে ভরসা, জিডিতেই নিরাশা

১৮

তারেক রহমানের পক্ষে মডেল মন্দির নির্মাণের ঘোষণা

১৯

তিন ব্যাংকের ২৩০০ কোটি টাকার বন্ড অনুমোদন দিল বিএসইসি

২০
X