শারদীয় দুর্গোৎসবের মহাষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত পাঁচ দিনব্যাপী চলে পূজা-অর্চনা, আনন্দ-উল্লাস ও ভক্তিমূলক পরিবেশ। সেই উৎসবের পর বৃহস্পতিবার (২ অক্টোবর) দুপুর থেকে শুরু হয় বিসর্জনের প্রস্তুতি। কিন্তু বিদায়ের দিন শহরজুড়ে নেমে আসে টানা বৃষ্টি। বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে বিকেলে হাজারো ভক্ত-অনুরাগী ছুটে যান সুরমা নদীর তীর চাঁদনীঘাট বিসর্জন স্থলে।
বৃষ্টির ফোঁটা ঝরতে থাকলেও ঢাক-ঢোল, কাশির সুর ও উলুধ্বনিতে মুখর হয় সিলেট নগরী। পূজা কমিটির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সাধারণ ভক্তরাও অংশ নেন শোভাযাত্রায়। রঙিন প্রতিমা কাঁধে নিয়ে ভক্তরা এগিয়ে যান বিসর্জন ঘাটের দিকে। নগরীর চৌহাট্টা, জিন্দাবাজার, দাঁড়িয়াপাড়া, পাঠানঠুলা, বাগবাড়িসহ বিভিন্ন এলাকার মণ্ডপ থেকে একে একে প্রতিমা আসা শুরু করে সুরমা নদীর তীরে।
দুপুরের পর থেকে বিভিন্ন মণ্ডপ থেকে প্রতিমা ট্রাকে নিয়ে শোভাযাত্রা করে পুণ্যার্থীরা জড়ো হতে থাকেন নগরীর কিন ব্রিজের উত্তরপ্রান্তে, চাঁদনীঘাটে। এ সময় সুরমা পয়েন্ট, সিটি পয়েন্ট, তালতলা, সুরমা মার্কেট, জেলা পরিষদের সম্মুখভাগ ছিল লোকে লোকারণ্য। ঢাক-ঢোল ও নৃত্যের সঙ্গে ভক্তরা ‘বলো দুর্গা মাই কি’ স্লোগানে মুখর করে তোলেন চারপাশ। এ ছাড়াও রেকর্ডে বাজতে থাকে বিভিন্ন ধরনের গান।
এদিন বিকেল ৪টা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিমা বিসর্জন কার্যক্রম শুরু হয়। এসময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন সিলেট জেলা ও মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
শিল্পী রাণী, স্বপন কুমার, ধনঞ্জয় বৈদ্য, অসিত রঞ্জন দেসহ ভক্তরা জানান, বিদায়ের মুহূর্ত সবসময়ই বেদনার। মায়ের আশীর্বাদ কামনায় চোখ ভিজে ওঠে সবার। তবে এ বছরের বিদায়ে প্রকৃতিও যেন সিক্ত হয়ে সঙ্গ দিয়েছে বৃষ্টি হয়ে।
এদিকে, নগরীর বিভিন্ন মণ্ডপ থেকে নারী-পুরুষ, তরুণ-তরুণী ও শিশুদের ঢল নামে। অনেকে ছাতা নিয়ে, আবার কেউ ভিজেই মেতে ওঠেন এই বিদায়ী উৎসবে। শুভ বিদায় মায়ের, আবারও আগমনের প্রতীক্ষা—এই স্লোগান ও প্রার্থনায় ভক্তরা বিদায় জানান দেবী দুর্গাকে। প্রতিমা বিসর্জনের পর ভক্তরা একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করে বিজয়া দশমীর শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। বৃষ্টি ভেজা সিলেটে তাই এবারের দুর্গোৎসবের শেষ দিনটিও রঙিন স্মৃতি আর আবেগঘন বিদায়ের মধ্য দিয়েই শেষ হয়।
এর আগে, দশমীর দিনে মণ্ডপে মণ্ডপে দেবী দুর্গাকে সিঁদুর দেওয়ার মাধ্যমে সিঁদুর খেলায় মাতেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। এ সময় সব অশুভ শক্তির বিনাশ ও শুভ শক্তির বিকাশের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রার্থনা করেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। বিজয়া দশমী উপলক্ষে বিভিন্ন সংঘের উদ্যোগে শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। দর্পণ বিসর্জন আর দেবী আরাধনায় শেষ হয় দশমীর আচার-অনুষ্ঠান।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ সিলেট মহানগর এবং জেলা শাখা সূত্রে জানা গেছে, এ বছর জেলায় ৬১৮টি মণ্ডপে পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সিলেট মহানগরে সার্বজনীন ১৪২টি ও পারিবারিক ২০টি মিলিয়ে মোট ১৬২টি এবং জেলার বিভিন্ন উপজেলায় সার্বজনীন ৪২৭টি ও পারিবারিক ২৯টি মিলিয়ে মোট ৪৫৬টি পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ সিলেট জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রঞ্জন ঘোষ কালবেলাকে বলেন, এবারের দুর্গাপূজা শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারি থাকায় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
অন্যদিকে, বিজয়া শোভাযাত্রা ও প্রতিমা বিসর্জনকে ঘিরে এদিন বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা বজায় ছিল। র্যাব, সেনাবাহিনী, আনসার ও পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত থেকেছে। এ ছাড়াও পাঁচ দিনব্যাপী এ দুর্গোৎসব যেন নির্বিঘ্নে ও উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয় সেজন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। পূজার সার্বিক নিরাপত্তায় চালু ছিল হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ও হটলাইন নম্বর। পাড়া-মহল্লায় পরিবেশ ঠিক রাখতে ড্রোন ওড়ানোর পাশাপাশি সোশাল মিডিয়া মনিটরিংয়ে নিয়োজিত ছিল মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার টিম।
উল্লেখ্য, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মতে এবার দেবী দুর্গার আগমন ঘটে গজে অর্থাৎ হাতির পিঠে চড়ে। গজে আগমন বা গমন হলে পৃথিবী শস্য-শ্যামলা হয়। আর দশমীতে দেবীর প্রস্থান ঘটেছে দোলায় চড়ে।
মন্তব্য করুন