

কটিয়াদী উপজেলার আচমিতা বাজার সংলগ্ন ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের পেছনে, একটি ঘরে নিঃশব্দে চলে এক নারী যোদ্ধার যুদ্ধ। বয়স তার ৫৫। নাম জাহানারা বেগম। বয়সের ভার, দারিদ্র্যের যন্ত্রণা আর ভাগ্যের নিষ্ঠুরতার চাপে বহু আগেই ভেঙে পড়ার কথা ছিল তার, কিন্তু তিনি ভাঙেননি। কারণ তার ভাঙার সুযোগ নেই, চারজন প্রতিবন্ধী মানুষ তার আশ্রিত, তারই সন্তানসম।
টিনের ঘরেই চারজন প্রতিবন্ধী নিয়ে কাটছে জাহানারার দিনরাত্রি। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে এক সুখী পরিবারের বসবাস এই ঘরটিতে। কিন্তু ঘরের ভেতরেই গড়ে উঠেছে এক মায়ের অসীম ধৈর্য, ত্যাগ আর কান্নায় ভেজা ভালোবাসার পৃথিবী।
জানা যায়, কয়েক বছর আগে মারা যান জাহানারার স্বামী। তখন থেকেই জীবনের মূল আশ্রয় হারান তিনি। সন্তান, ভাইবোন, আত্মীয় কেউ পাশে দাঁড়ায়নি। বাধ্য হয়ে ফিরে যান বাবার বাড়িতে। কিন্তু বাবাও তখন বেঁচে নেই। মা মারা গেছেন আরও আগে। দুই ভাই থাকলেও তাদের সঙ্গে বহু বছর ধরে কোনো যোগাযোগ নেই। একসময় ছিল আত্মীয়তার বন্ধন, এখন আছে শুধু একা বেঁচে থাকার লড়াই।
জাহানারার সংসারে চারজন প্রতিবন্ধী সদস্য। প্রত্যেকের গল্প আলাদা, কিন্তু কষ্ট একই। প্রথম কন্যা চাঁদনী (২৬) ও দ্বিতীয় কন্যা আঁখি (২২), দুজনেই মানসিক ভারসাম্যহীন। কখনো হাসে, কখনো কাঁদে, আবার হঠাৎ চুপ হয়ে যায়। মা ছাড়া কেউ তাদের সামলাতে পারে না। কখনো ভয়ে, কখনো অজানা রাগে ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর করে ফেলে।
বোন মিনা আক্তার (৪৩) শারীরিক প্রতিবন্ধী। হাঁটতে পারেন না। দীর্ঘদিন ধরে হাঁটুর ভেতরে টিউমার ধরা পড়েছে, যা প্রতিদিনই বাড়ছে। ব্যথায় কাতর মিনা বলেন, অপারেশন করানো দরকার, কিন্তু টাকাই নাই। পায়ে দাঁড়াতে পারলে আমি কাজ করতাম, আপার (জাহানারার) কষ্ট একটু কমত।
অন্যদিকে ভাগ্নে মনির হোসেন (৩৯) পুরোপুরি দৃষ্টি হারিয়েছেন। জন্ম থেকেই আংশিক অন্ধত্ব ছিল, এখন আর কিছুই দেখতে পান না। চিকিৎসকরা বলেছেন, কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করলে হয়তো চোখে আলো ফিরতে পারে। কিন্তু সেই চিকিৎসা করানোর মতো সামর্থ্য কোথায়? মনির শান্ত কণ্ঠে বলেন, আমি আলো দেখি না, কিন্তু জানি আমার খালা আমাদের জন্য দিনরাত লড়ে যায়। আল্লাহ যেন তাকে সুস্থ রাখে।
এই চারজনের যত্ন নিতে নিতে জাহানারা নিজেই আজ এক অসুস্থ নারী। ফুসফুস ও হৃদরোগ তাকে প্রায় অচল করে দিয়েছে। অনেক সময় শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, কিন্তু ঘরে বসে থাকার সুযোগ নেই। মেয়েদের খাওয়া, বোনের ওষুধ, ভাগ্নের যত্ন সব কিছু তাকেই সামলাতে হয়। কখনো প্রতিবেশীরা একটু ভাত দেন, কখনো পুরোনো কাপড়। মাসে একবার কেউ যদি কিছু সহায়তা করে, তাতেই কৃতজ্ঞ হয়ে যান তিনি। কিন্তু সব দিন সমান যায় না। অনেক দিন পুরো পরিবার না খেয়েই রাত কাটায়।
জাহানারা বেগম বলেন, বাবা-মা চলে যাওয়ার পর মনে হলো, আমিও একদিন চলে যাব। কিন্তু এদের রেখে কোথায় যাব। এই আমার দুনিয়া, এই আমার বোঝা, আবার এই আমার আশীর্বাদ। আমি কিছু চাই না নিজের জন্য। আমার মরার আগে যদি ওদের একটু ভালো জায়গায় রাখতে পারতাম, তাহলে শান্তি পেতাম।
প্রতিবেশী এক বৃদ্ধা বলেন, ওই ঘরে গেলে বুক ভরে কান্না আসে। দিনরাত ওরা কষ্টে থাকে। কখনো খেতে পায়, কখনো পায় না। জাহানারা নিজেরে ভুলে গেছে, শুধু অন্যদের জন্য বাঁচে। সমাজে হাজারো বিত্তশালী মানুষ আছেন, যাদের এক দিনের বিলাসের অর্থেই হয়তো এই পরিবারটির বছর কেটে যেতে পারে। অথচ তাদের কাছে পৌঁছায় না এই কান্নার খবর, এই মায়ের লড়াইয়ের গল্প। আমাদের সামান্য সহযোগিতা, একটি হুইলচেয়ার, কিছু খাদ্যসামগ্রী, সামান্য চিকিৎসা সহায়তা হয়তো এই পরিবারটিকে অনাহার থেকে, হতাশা থেকে, মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারে।
আচমিতা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মতিউর রহমান বলেন, আমি এ পরিবারটি সম্পর্কে জেনেছি। আমার পরিষদের পক্ষ থেকে সুযোগ সুবিধা প্রদানের চেষ্টা করব। ব্যক্তিগতভাবেও সাধ্যমতো সহযোগিতা করব, ইনশাল্লাহ।
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. আবুল খায়ের বলেন, ইতোমধ্যে এ চারজনকেই সামাজিক নিরাপত্তা প্রতিবন্ধী ভাতার আওতায় নেওয়া হয়েছে। উনারা নিয়মিত ভাতা পাচ্ছেন। তারপরেও উনাদের জন্য আরও কিছু করা যায় কিনা আমরা দেখছি।
মন্তব্য করুন