

নরসিংদীতে খুনের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে একের পর এক হত্যাকাণ্ড কিংবা হত্যার উদ্দেশে হামলা জেলাবাসীর মনে বাড়াচ্ছে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। এক ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে অন্য আরেক ঘটনা উদ্বেগের বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়। জেলার এখানে সেখানে পড়ে থাকে অজ্ঞাত পরিচয়ের লাশ, যদিও পরে প্রযুক্তির সহায়তায় অনেক লাশেরই মিলে পরিচয়।
এদিকে যে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি করা হয়েছিল, সে অস্ত্রটিও মঙ্গলবার (১৬ ডিসেম্বর) রাতে নরসিংদী থেকে উদ্ধার করা হয়। র্যাবের দেওয়া তথ্যমতে, দুটি বিদেশি পিস্তল, দুটি ম্যাগাজিন, একটি খেলনা পিস্তল ও ৪১ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়।
জনসাধারণের মনে প্রশ্ন- তবে কি অস্ত্রের হাট নরসিংদী? এখানেই কি অস্ত্র কেনা-বেচা হয়? নরসিংদীতে এত অস্ত্র আসছে কোথা থেকে। এছাড়া প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও চলছে অস্ত্রের মহড়া, ছিনতাই, হামলা এবং প্রকাশ্যে গোলাগুলি। সাধারণ মানুষের মনে আতঙ্ক বিরাজ করছে, অপরাধীদের কাছে যেন জিম্মি হয়ে পড়েছে মানুষের জীবন।
সামনে নির্বাচন, অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক ঘটনা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন জেলার সচেতন মহল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপরতার মধ্যেও এসব ঘটনায় মানুষের মধ্যে যেন এক অজানা আতঙ্ক তাড়া করে ফিরছে। যার ভয় এখন প্রতিটি মানুষের মনেই গেঁথে আছে ।
সচেতন মহল বলছে, ব্যবসায়িক-রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, ছিনতাই, দ্বন্দ্ব ও আধিপত্য বিস্তারই এর মূল কারণ। একসময় রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হলেও এখন ছিনতাই, অস্ত্র-মাদক, জমিসংক্রান্ত বিরোধ, ইন্টারনেট-ডিশ ও বালু ব্যবসাসহ নানা তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই হত্যাকাণ্ড ঘটছে।
এমন পরিস্থিতিতে নরসিংদী জেলার ৬টি উপজেলায় গত ১৭ দিনে ৭টি লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। আধিপত্য বিস্তার, ছিনতাইসহ বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে।
সর্বশেষ ১৬ ডিসেম্বর দুপুরে শিবপুর উপজেলার বড়ইতলা এলাকায় একটি ময়লার ড্রেন থেকে আব্দুল্লাহ নামে কোরআনে হাফেজের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। আব্দুল্লাহ পলাশ উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের সেকান্দরদী গ্রামের মুক্তার হোসেনের ছেলে। এর আগে গত ২২ নভেম্বর তার মাদ্রাসা থেকে বের হয়ে আর বাড়ি ফিরেনি আব্দুল্লাহ। জানা গেছে, সেকান্দরদী মধ্যপাড়া হাফিজিয়া মাদ্রাসার হেফজ বিভাগের ছাত্র আব্দুল্লাহ।
গত ২২ নভেম্বর মাদ্রাসা থেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হয়ে আর ফিরেনি। পরে অনেক খোঁজাখুঁজি করে তাকে না পেয়ে পলাশ থানায় সাধারণ ডায়েরি করে পরিবার। মঙ্গলবার সকালে ড্রেন থেকে দুর্গন্ধ ছড়ালে আশপাশের লোকজন পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ দুপুরে ঘটনাস্থলে পৌঁছে আদুরী গার্মেন্টসের ইটিপি প্লান্টের ময়লার ড্রেন থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য নরসিংদী সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। পরে পরিবারের লোকজন খবর পেয়ে নরসিংদী সদর হাসপাতালে এসে আব্দুল্লাহর পরিচয় শনাক্ত করে।
এছাড়া ১২ ডিসেম্বর পলাশ উপজেলার জিনারদী ইউনিয়নের কাটাবের সড়কের পাশ থেকে অজ্ঞাতনামা বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় পরিচয় সনাক্ত। তার নাম নয়ন চন্দ্র মজুমদার (২৮)। তিনি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ থানার উত্তর মগধরা গ্রামের দিলাল চন্দ্র মজুমদারের ছেলে। তিনি পলাশ উপজেলার ঘোড়াশাল বাজারের একটি ভাড়া বাসায় থেকে পার্শ্ববর্তী ঘাগড়া গ্রামে নিজের সেলুনে নরসুন্দরের কাজ করতেন।
৮ ডিসেম্বর রায়পুরা উপজেলার নিলক্ষা দড়িগাঁও এলাকায় আহত হয়েছেন। নিহত যুবকের নাম- মামুন মিয়া (২৫)। তিনি দড়িগাঁও গ্রামের আব্দুল আউয়ালের ছেলে ও একজন কুয়েত প্রবাসী ছিলেন। তিনি ১৫ দিন পূর্বে কুয়েত থেকে পাঁচ মাসের ছুটি নিয়ে দেশে ফেরেন।
৫ ডিসেম্বর বেলাবো উপজেলার আড়িয়াল খাঁ নদের পাড় থেকে আব্দুর রশিদ (৪০) নামে এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। তিনি কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি থানার লোহাজুরি গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল আওয়াল এর ছেলে। স্থানীয়দের ভাষ্য, নিহত রশিদ প্রতিদিন সন্ধ্যায় আড়িয়াল খাঁ নদীর তীরে মাছ ধরতে আসতেন। মঙ্গলবার সন্ধ্যাতেও তিনি স্বাভাবিক মতো মাছ ধরতে বের হলেও আর বাড়ি ফিরেননি।
২ ডিসেম্বর একই উপজেলার বাঁশগাড়ীতে প্রাণতোষ সরকার (৪২) নামে এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। পরিবার জানায়, মঙ্গলবার রাতে বাড়িতে অবস্থান করছিলেন প্রাণতোষ সরকার। এ সময় প্রাণতোষের সঙ্গে কথা বলার জন্য দুজন লোক তাকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায়। পরে তারা বাঁশগাড়ী দিঘলিয়াকান্দী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে প্রাণতোষকে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে।
২ ডিসেম্বর আল আমিন (২৯) নামে এক ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকের মরদেহ মনোহরদী উপজেলার দৌলতপুর ইউনিয়নের পাথরদিয়া ঈদগাহ মাঠ সংলগ্ন স্থান থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। নিহত আল আমিন নরসিংদী সদর উপজেলার শিলমান্দী এলাকার চাঁন মিয়ার ছেলে। পুলিশ জানায়, একদল ছিনতাইকারী ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাটি ভাড়া করে আল আমিনকে নিয়ে যায় মনোহরদী। পরে সুবিধামতো সময়ে তাকে হত্যা করে তার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাটি নিয়ে যায়।
২৯ নভেম্বর আমিরগঞ্জ ইউনিয়নের সংগীতা-আমিরগঞ্জ সড়কের বদরপুর এলাকার সড়কের পাশ থেকে শাহাদাৎ হোসেন (১৪) নামে এক কিশোরের গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। পরিবার ও স্থানীয়দের ধারণা, দুর্বৃত্তরা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে শাহাদাৎকে গলাকেটে মৃত্যু নিশ্চিত করে সংগীতা-আমিরগঞ্জ সড়কের বদরপুর এলাকায় সড়কের পাশে ফেলে রেখে গেছে।
এদিকে যে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি করা হয়েছিল, সেটি নরসিংদী থেকে উদ্ধারের কথা জানিয়েছে র্যাব। র্যাবের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে থেকে জানা গেছে, নরসিংদী শহরের তরোয়া এলাকার একটি বিলের পানির মধ্য থেকে ২টি বিদেশি পিস্তল, ২টি ম্যাগাজিন, ১টি খেলনা পিস্তল ও ৪১ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় মো. ফয়সাল (২৫) নামে একজনকে আটক করা হয়েছে।
ওসমান হাদিকে গুলি করার ঘটনায় প্রধান সন্দেহভাজন ফয়সল করিম মাসুদের শ্বশুরবাড়ি নরসিংদী শহরের শাপলা চত্বর এলাকায়। শ্যালক ওয়াহিদ আহমেদের (শিপু) দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মঙ্গলবার নরসিংদী শহরের তরোয়া এলাকার বিলে অভিযান চালিলে এসব উদ্ধার করে। ওয়াহিদ আহমেদের বাড়ি অর্থাৎ ফয়সল করিমের শ্বশুরবাড়ি নরসিংদী শহরের তরোয়া এলাকায়। এর আগে গত রোববার (১৪ ডিসেম্বর) ফয়সলের স্ত্রী সামিয়া, শ্যালক শিপু ও বান্ধবী মারিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়।
রাশেদুল হাসান নামে একজন সমাজ সেবক বলেন, প্রতিনিয়ত যে ঘটনাগুলো ঘটছে এতে আমরা বাইরে বের হলে একদিকে যেমন নিজে আতঙ্কের মধ্যে থাকি অন্যদিকে পরিবারও থাকে আতঙ্কের মধ্যে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আরও তৎপরতা বাড়ানো উচিত। সামনে নির্বাচন আসছে, এ রকম ঘটনা যেন না বাড়ে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বাড়ালে জনগণের মধ্যে স্বস্তি ফিরবে, নতুবা আতঙ্কের মধ্যেই আমাদের চলতে হবে। আজ অন্য কেউ কাল আমার ক্ষেত্রেও ঘটনা ঘটতে পারে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) নরসিংদী জেলার সাধারণ সম্পাদক হলধর দাস বলেন, পর্যায়ক্রমে একের পর এক ঘটনা ঘটেই চলেছে। একটি ঘটনা নির্বৃত্ত হচ্ছে তো আরেক ঘটনা এসে হাজির। অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের বেপরোয়া তৎপরতা কমছেনা। পুলিশ সাধ্যমতো চেষ্টা করেও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছেনা।’ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর সাধারণ মানুষের আস্থার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনতে একদিকে যেমন পুলিশের কঠোর ভূমিকা প্রয়োজন, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের সচেতনতাও জরুরি। তবেই অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
নরসিংদীর পুলিশ সুপার মো. আবদুল্লাহ্-আল-ফারুক বলেন, হত্যাকাণ্ডের রহস্যগুলো উদ্ঘাটন করে আসামি গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। বর্তমানে জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও উন্নতির দিকে।
মন্তব্য করুন