

প্রকৃতি ঘিরে শূন্যে উড়ে উড়ে নিঃশব্দ নৃত্যের রঙিন প্রজাপতিরা যেন প্রকৃতির নিজস্ব ভাষার কাব্য। এক ফুল থেকে আরেক ফুলে, এক গাছ থেকে আরেক গাছে উড়ে বেড়ানো এ ছোট প্রাণীগুলো শুধু সৌন্দর্যের প্রতীকই নয়, প্রকৃতির ভারসাম্যেরও নীরব রক্ষক। পরিবেশ ভালোমন্দের নির্দেশক।
গ্রামবাংলার সবুজ মাঠ, ঝোপঝাড় কিংবা নদী পাড়ে হঠাৎ চোখে পড়া রঙিন ডানার প্রজাপতিরা যেন মুহূর্তেই বদলে দিতে পারে চারপাশের দৃশ্যপট, এনে দিতে পারে প্রশান্তি ও মুগ্ধতার অনুভূতি। প্রকৃতির এই অনিন্দ্যসুন্দর সৃষ্টি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সৌন্দর্য কখনো কখনো সবচেয়ে নীরব রূপেই ধরা দেয় এবং প্রাণবন্ত রূপে।
তেমনই এক সৌন্দর্য গুণে অনন্য প্রজাপতি তিলাইয়া কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ার গ্রামীণ প্রকৃতিকে প্রাণবন্ত করে রেখেছে। উপজেলার ঝোপঝাড়, খালপাড়, জলাশয়ের পাড় আর মৌসুমি ফুলে ভরা সবুজের রাজ্যে এদের বিচরণ প্রাকৃতিক পরিবেশকে মুখরিত করে রেখেছে। আকারে ছোট হলেও সৌন্দর্য আর পরিবেশগত গুরুত্বে এই প্রজাপতির ভূমিকা অনন্য।
তিলাইয়া প্রজাপতির বৈজ্ঞানিক নাম ক্যাস্টালিয়াস রোসিমন। এর ইংরেজি নাম কমন পিয়েরোট বা ব্ল্যাক-স্পটেড পিয়েরোট। এটি সাজুন্তি নামেও পরিচিত। এটি লাইসিনিডি পরিবারভুক্ত ছোট আকারের প্রজাপতি। এদের সাদা দেহের ওপর অসংখ্য ছোট-বড় কালো ফোঁটার মতো ছোপ বা চিহ্ন রয়েছে। আর এজন্য এটির নামকরণ করা হয়েছে তিলাইয়া। দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে এ প্রজাপতির উপস্থিতি বেশি।
তিলাইয়া প্রজাপতির মুখমণ্ডল সাদা। এর চোখ কালো। সামনের ডানার নিচের দিকটা সাদা এবং তাতে বিভিন্ন আকারের কতগুলো ফোঁটা বা দাগ সুন্দরভাবে সাজানো থাকে। পেছনের ডানার ঠিক মাঝামাঝি কোনো ফোঁটা থাকে না। তবে নিচের প্রান্তে গোড়ার দিকে একটি উজ্জ্বল সবুজ গোলাকার ফোঁটা আছে। এদের পিছনের ডানায় খুব সরু, কালো আর সাদায় মেশানো একটা লেজ থাকে। ওপর দিক থেকে দেখলে ডানার গোড়া ধাতব সবুজ দেখায়। সামনের ও পেছনের ডানার প্রান্তে মোটা কালো বা কালচে ধূসর রেখা থাকে। তাতে থাকে ছোট সাদা ফোঁটা। পুরুষ ও স্ত্রী দেখতে একইরকম হয়।
তিলাইয়া প্রজাপতিরা রাস্তার ধারে জন্মানো ফুল, বিভিন্ন রঙের বা হলুদ রঙের ক্ষুদ্র পুষ্প, ক্ষেতের আগাছা, বিভিন্ন ঝোপঝাড়, জলাশয়ের পাড়ের ছোট ছোট গাছগাছালি কিংবা বাড়ির আঙিনায় লতানো গাছে বা প্রায় সবখানেই এদের অবাধ বিচরণ।
এদের সকালের নরম রোদে ফুলের ওপর বসে মধু আহরণ করতে দেখা যায়। এর ফলে একদিকে যেমন ফুলের পরাগায়ন হয়, অন্যদিকে টিকে থাকে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। পরিবেশবিদদের মতে, কোনো এলাকায় প্রজাপতির উপস্থিতি মানেই সেই এলাকার পরিবেশ তুলনামূলকভাবে স্বাস্থ্যকর।
স্থানীয় প্রকৃতিপ্রেমীরা মনে করছেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতিতেও পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার, গাছপালা ও ঝোপঝাড় কমে যাওয়া, জলাভূমি ভরাটের মতো কর্মকাণ্ড তিলাইয়ার মতো সংবেদনশীল প্রজাপতির জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। তারা জোর দিয়ে বলছেন, যদি এখনই সচেতনতা না বাড়ানো যায়, তবে ভবিষ্যতে এই ধরনের সুন্দর সুন্দর প্রজাপতিরা অস্তিত্ব সংকট পড়তে পারে।
প্রকৃতিপ্রেমী প্রাক্তন স্কুলশিক্ষক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রজাপতি শুধু সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, এটি পরিবেশের ভারসাম্য ও সুস্থতার বার্তাবাহক। আমাদের চারপাশের প্রকৃতিতে উড়ে বেড়ানো তিলাইয়া প্রজাপতির মতো প্রজাপতিরা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রকৃতি ও স্রষ্টার সৃষ্টিকে ভালোবাসলে প্রকৃতিও তার প্রতিদান আমাদেরকে ফিরিয়ে দেয়। ভালো দিকটা যেমন দেয়, খারাপ দিকটাও তেমনি ফিরিয়ে দেয়। এজন্য সুন্দর সুন্দর প্রজাপতিদের রক্ষায় কম কীটনাশক ব্যবহার এবং প্রকৃতিবান্ধব জীবনযাপন জরুরি। আমাদের আশপাশের সবুজ সংরক্ষণ জরুরি।
কৃষিবিদ মো. মাসুদ রানা কালবেলাকে বলেন, প্রজাপতি শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অংশই নয়, এরা আমাদের কৃষি ও পরিবেশের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এরা বিভিন্ন ফুল থেকে মধু সংগ্রহের সময় পরাগায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, যা ফসল উৎপাদনে সহায়ক। প্রজাপতিদের উপস্থিতি একটি এলাকার পরিবেশ স্বাস্থ্যকর থাকার ইঙ্গিত দেয়। তবে শুঁয়াপোকা ফসলের বা গাছের পাতা খেয়ে জীবনধারণ করার কারণে ফসল বা গাছের ক্ষতিসাধন হয়।
মন্তব্য করুন