ঢাকঢোলের বাজনা আর কাঁসা-শঙ্খের আওয়াজে এখন মুখর পুরো রাজশাহী। ভক্তদের উলুধ্বনিতে দেবী দুর্গাকে পরম শ্রদ্ধায় জানানো হচ্ছে স্বাগত। শুধু তাই নয়; নারী জাতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের বাসনায় মণ্ডপে মণ্ডপে পালিত হয়েছে কুমারী পূজা। সবার মঙ্গল কামনা এবং পাপমুক্তির জন্য ভক্তরা দেবীর পায়ে জানাচ্ছেন শ্রদ্ধা। বিভিন্ন মন্দিরে অঞ্জলি শেষে ভক্তদের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে প্রসাদ। এত সব আয়োজনের মাধ্যমে পুরো রাজশাহীতে যেন দুর্গাপূজায় অন্য রকম এক উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে।
সরেজমিন রাজশাহী নগরীর বিভিন্ন পূজামণ্ডপে দেখা গেছে, সারা দেশের মতো পদ্মাপাড়ের নগরীতেও দুর্গাপূজায় তৈরি হয়েছে ভিন্ন এক আমেজ। বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী পূজামণ্ডপ সেজেছে দৃষ্টিনন্দন সাজে। এর মধ্যে সনাতন ধর্মাবলম্বীসহ নগরবাসীর নজর কেড়েছে রাজশাহী শহরের প্রাণকেন্দ্র গণকপাড়া এলাকায় টাইগার সংঘ পূজামণ্ডপ। মণ্ডপটি বাংলাদেশ ডাক ভবনের আদলে তৈরি করা হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে পূজামণ্ডপটি বিভিন্ন ব্যতিক্রম থিমে সাজানো হচ্ছে। কখনো আইয়ুব বাচ্চুর রুপালি গিটারে, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, বাহুবলী, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, করোনাকালে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও মাস্কের আদলে কিংবা বিশ্বকাপের ট্রফিতে। আর এবার এটিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ডাক বিভাগের আদল।
গতকাল রোববার সকালে গণকপাড়ার ওই মণ্ডপে গিয়ে দেখা গেছে, ঢাকায় আগারগাঁওয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ ডাক বিভাগের ভবনের আদলে পূজামণ্ডপটির ওপরের অংশটি করা হয়েছে। সেই ভবনের নিচে ভেতরে মা দুর্গাকে রাখা হয়েছে। মনে হতে পারে ডাক ভবনে প্রবেশ করতেই দুর্গার প্রতিমা। দুই পাশে রাখা হয়েছে দুষ্প্রাপ্য ও ঐতিহাসিক ডাক টিকিটের ছবি। ডাক টিকিটে গ্রামবাংলার চিত্রসহ বাংলাদেশের নানা সাফল্য তুলে ধরা হয়েছে। মণ্ডপে ঢুকতেই ডান পাশে বড় করে লাগানো চিঠি পাঠানোর ঠিকানা লেখার স্থান। মণ্ডপের সামনে দাঁড়ালে ডাকঘর আদলে করা ভবনের সামনে দেখা যায়, প্রাঙ্গণজুড়ে রানারের প্রতিকৃতি। মণ্ডপের বাইরের দিকে দুপাশে পুরোনো দিনের চিঠি একত্র করে বোর্ডে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই রকম বড় বড় দুই বোর্ডে ১২টি করে ২৪টি চিঠি রয়েছে।
পূজামণ্ডপের একটু সামনেই নির্মাণ করা হয়েছে মাটির পোস্টমাস্টার। যার বাম হাতে একটি হারিকেন। আর ডান হাতে কাঁধের ওপর একটি লাঠি। সেই লাঠিতে একটি ব্যাগ ঝোলানো এবং সেই ব্যাগের মধ্যে পোস্ট অফিসের বিভিন্ন চিঠিপত্র। এ ছাড়া ঠিক তার বাঁ দিকে টানানো হয়েছে একটি বোর্ড। যেখানে প্রদর্শিত হচ্ছে পুরোনো দিনের বিভিন্ন চিঠিপত্র। এ বিষয়ে জানতে চাইলে টাইগার সংঘের সভাপতি পার্থ পাল চৌধুরী বলেন, ‘আমরা প্রতিবারই বিভিন্ন থিমের আদলে পূজামণ্ডপ তৈরি করার চেষ্টা করি। এবারও তার ব্যত্যয় হয়নি। এবার আমরা পোস্ট অফিসকে থিম হিসেবে বেছে নিয়েছি। আশা করছি দর্শনার্থীদের ভালো লাগবে।’
এদিকে এরই মধ্যে গত শনিবার থেকে দুর্গা দেবীকে আসন-বসন, নৈবেদ্য ও পুষ্পমাল্য প্রদান করে ধূপ ও দীপ দিয়ে পূজা করেছেন ভক্তরা। গতকাল রোববার ছিল মহাষ্টমী। এদিন শহরের মণ্ডপে-মণ্ডপে চলে পবিত্র চণ্ডীপাঠ, পূজা-অর্চনা ও পুষ্পাঞ্জলি। এ ছাড়া কুমারী মেয়েকে দেবী ও মাতৃরূপে সাজিয়ে সম্পন্ন হয় কুমারী পূজাও। গতকাল দুপুর ১২টায় মহাষ্টমীতে নগরীর বোয়ালিয়া মডেল থানার শাহ মখদুম কলেজের সামনের ‘ত্রি-নয়নী মন্দির’ এবং দুপুর দেড়টায় নগরীর শাহ মখদুম থানার কয়েরদাঁড়া এলাকার মথুরডাঙ্গা ‘করুণাময়ী সংঘ’ মন্দিরে হয়েছে কুমারী পূজা।
‘করুণাময়ী সংঘ’ মন্দিরের সভাপতি পার্থ সারথী প্রামাণিক জানান, টানা ৯ বছর ধরে তারা এই মন্দিরে কুমারী পূজা হয়ে আসছে। রোববার দুপুর দেড়টায় ৯ বছরের শিশু রূপাঞ্জনা দেবীর আসনে বসলে মন্দিরের পুরোহিত সৈকত সরকার কুমারী পূজা শুরু করেন। এ সময় রূপাঞ্জনার মা কলি গোস্বামী ও বাবা রণধীর রায়সহ অসংখ্য ভক্তরা উপস্থিত ছিলেন।
জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, গত শনিবার থেকে রাজশাহী শহরে ৭৯টি মণ্ডপে শারদীয় দুর্গোৎসব শুরু হয়েছে। যার মধ্যে হেতেম খাঁ এলাকার হরিজন পল্লির পূজামণ্ডপ, শেখেরচক এলাকার নেহেরিকা পূজামণ্ডপ, আলু পট্টি এলাকার কসমস, সাগরপাড়া এলাকার উৎসর্গ পূজা মন্দির, আলু পট্টি এলাকার সর্বজয়ী পূজামণ্ডপ, সাগরপাড়া এলাকার ত্রি-নয়নী পূজামণ্ডপ, কুমারপাড়া এলাকার সনাতন ধর্ম সংঘ, ফায়ার সার্ভিস ঘোষপাড়া এলাকার মিলন মন্দির, কোর্ট এলাকার হড়গ্রাম মন্দির, ফুদকিপাড়া এলাকার গীতাঞ্জলি পূজামণ্ডপ, ফুদকিপাড়া এলাকার কল্পতরু, কুমারপাড়া এলাকার তারা সংঘ, সাহেব বাজার কালী মাতার মন্দির, গনকপাড়া এলাকার লক্ষ্মী-নারায়ণ মন্দির, মিয়াপাড়া এলাকার ধর্মসভা মন্দির, অলকার মোড় এলাকার লাঠিয়াল মন্দির, নিউমার্কেট এলাকার নবরূপ, রানীবাজার এলাকার অ্যারোহেড, সাগরপাড়া এলাকার শিবালয়, বুধপাড়া এলাকার পূজামণ্ডপ, কাজলা ঘোষপাড়া মন্দির, রাজা হাতা কালী মন্দির, আইডি বাগানপাড়া এলাকার পূজামণ্ডপগুলো এবার দর্শনার্থীদের নজর কেড়েছে।
পূজামণ্ডপের সামগ্রিক পরিবেশ ও নিরাপত্তা নিয়ে জানতে চাইলে নগরীর কসমস পূজামণ্ডপের সভাপতি আসীম দে বলেন, ‘এ পর্যন্ত অত্যন্ত চমৎকার পরিবেশে দুর্গোৎসব পালিত হচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা পাচ্ছি।’
পদ্মা সার্বজনীন মন্দিরের সভাপতি জ্যোতি কুমার ঘোষ বলেন, ‘এখনো কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি আমাদের নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবক টিম রয়েছে। আশা করি উৎসবমুখর পরিবেশে এবারের শারদীয় দুর্গোৎসব সম্পন্ন হবে।’
রাজশাহী মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট শরৎচন্দ্র সরকার কালবেলাকে বলেন, ‘উৎসবমুখর পরিবেশে নগরীর ৭৯টি পূজামণ্ডপে শারদীয় দুর্গোৎসব শুরু হয়েছে। এর মধ্যে নগরীর বোয়ালিয়া থানাধীন মণ্ডপ রয়েছে ৫৫টি। কোথাও কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই এখন অত্যন্ত সুন্দরভাবে উৎসব পালিত হচ্ছে। আগামী দুই দিনও উৎসবমুখর পরিবেশেই পালিত হবে বলে আশা করছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আমাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে।’
র্যাব-৫-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল রিয়াজ শাহরিয়ার বলেন, ‘রাজশাহীতে দুর্গাপূজায় নাশকতার আশঙ্কা নেই। তার পরও অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সতর্ক আছে র্যাব। দুর্গাপূজায় সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে র্যাব ১৬ অক্টোবর থেকে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়েছে। রোবাস্ট পেট্রোলিং পরিচালনার মাধ্যমে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। এ ছাড়া যে কোনো ধরনের গুজব ও মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে র্যাবের সাইবার মনিটরিং টিম অনলাইনে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করছে। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ মণ্ডপগুলো সিসি ক্যামেরার মাধ্যমেও নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। আগামী ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত নিরাপত্তা জোরদার থাকবে। পূজামণ্ডপসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সুইপিং পরিচালনার জন্য বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, যে কোনো উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্পেশাল ফোর্সের স্ট্রাইকিং টিম প্রস্তুত আছে।’
রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদার বলেন, ‘যেখানে যেখানে পূজামণ্ডপ রয়েছে, নগর পুলিশ সেখানে খোঁজখবর রাখছে এবং নিয়মিত মনিটরিং করছে। অপ্রীতিকর কোনো ঘটনার খবর নেই। দুর্গাপূজার নিরাপত্তা নিয়ে পুলিশের পাশাপাশি আনসার ও র্যাব সদস্যরাও কাজ করছেন। আশা করি, সবার সমন্বিত কার্যক্রম ও সহযোগিতায় উৎসবমুখর পরিবেশে রাজশাহী মহানগরীতে শারদীয় দুর্গোৎসব সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে।’
মন্তব্য করুন