ভরা মৌসুমে এবারও পানি দিচ্ছে না দেশের বৃহত্তম গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্প। সবগুলোপাম্প নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। জিকে সেচ প্রকল্পের আওতায় প্রতিবছর মৌসুমের শুরু থেকেই ৩টি পাম্পের সাহায্যে পানি দেওয়া হতো। তবে চলতি বোরো মৌসুমের এক মাস পেরিয়ে গেলেও মিলছে না পানি।
কর্তৃপক্ষ (পাউবো) বলছেন, কয়েক বছর ধরে দুটি পাম্প বন্ধ ছিল। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে সর্বশেষ সচল পাম্পটিও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহ এবং আলমডাঙ্গা গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্পের আওতাধীন কৃষকরা দুর্ভোগে পড়েছেন। পানির অভাবে অনেক কৃষক ধান লাগাতে পারছেন না। কারও ধানের জমি শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেছে। কেউ কেউ শ্যালো ইঞ্জিন দিয়ে বিকল্প সেচের ব্যবস্থা করেছেন। এ সুযোগে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা পাম্প মালিকরা সেচের খরচ নিচ্ছেন বেশি। ফলে ব্যয় বাড়ছে আবাদে। এমন দুর্ভোগে পড়েছেন ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার হাজারো কৃষক। এবার খরচের টাকা ওঠা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন তারা।
কৃষকরা বলছেন, বোরো ধানে সবচেয়ে বেশি সেচ দিতে হয়। ক্ষেত প্রস্তুত থেকে শুরু করে দানা আসা পর্যন্ত সেচ লাগে। কখনো দিনে দুই বেলাও সেচ দিতে হয়। জানুয়ারি থেকেই ধান আবাদের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তারা। কিন্তু হঠাৎ পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের এখন দিশাহারা অবস্থা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, চলতি বোরো মৌসুমে উপজেলায় ৯ হাজার ৩৬৬ হেক্টর জমিতে ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এরমধ্যে জানুয়ারিতে মৌসুম শুরুর পর ৯ হাজার ১৬০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। ২৭ হাজার ৪৮০ জন কৃষক আবাদে যুক্ত। এ পর্যন্ত ৯০ শতাংশ কৃষক চারা রোপণ করেছেন। অন্যরা ক্ষেত প্রস্তুত করছেন। তবে এবার লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে।
উপজেলার শড়াতালা গ্রামের কৃষক মোকলেসুর রহমান বলেন, প্রতিবছর খালের পানি দিয়ে ধান চাষ করি। এক বিঘা জমিতে ধান লাগিয়েছি। কিন্তু ধান লাগানোর পর থেকেই পানি পাচ্ছি না। বাধ্য হয়ে শ্যালো ইঞ্জিন ভাড়া করে সেচ দিচ্ছি। খালের পানির জন্য গুনতে হয় ২০০ টাকা। কিন্তু এবার শ্যালো মেশিন ভাড়া বাবদ দিতে হবে এক মণ ধান। সঙ্গে ৫ হাজার টাকার ডিজেল কিনতে হবে। জমির মালিককে দিতে হবে ৮ মণ ধান। সবকিছু নিয়ে চিন্তায় আছি।
কৃষকরা বলছেন, খালে পানি না আসায় সেচের পেছনে ডিজেল ও মেশিন ভাড়াসহ ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা খরচ হবে তাদের। বাড়তি খরচের আশঙ্কায় অনেক কৃষক ধান চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। অবিলম্বে পানি সরবরাহ চালু করে হাজারো কৃষককে বাঁচাতে হবে।
সরেজমিন উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় মাঠে ঘুরে আবাদে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে কৃষকের। উপজেলার হরিশপুর গ্রামের মাঠে ক্ষেতের পরিচর্যা করছিলেন শিপন আলীসহ কয়েকজন। শিপন জানান, এবার তিনি দুই বিঘা জমিতে বোরো ধান আবাদ করছেন। জিকের পানি না পেয়ে ব্যক্তি মালিকানার শ্যালো ইঞ্জিনের সাহায্যে সেচ দিচ্ছেন। এতে বিঘাপ্রতি ১০-১২ হাজার টাকা ব্যয় হচ্ছে। জিকের পানি নালার মাধ্যমে নিলে বিঘা প্রতি ব্যয় হয় মাত্র ৩০০ টাকা। ফলনও ভালো হয়। কিন্তু এ পানি না পাওয়ায় তিনি এবার উৎপাদন খরচ ওঠা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন।
সেচ খরচ বেশি নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে শাহিন ইসলাম নামে এক পাম্প মালিক বলেন, রাতদিন শ্যালো মেশিন চলে। এতে ইঞ্জিনের যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং মাঝেমধ্যে সেগুলো মেরামতও করা লাগে। কৃষক তিন থেকে চার মাস পর ধান বিক্রি করে টাকা দেন। পানি বিক্রি করে যে টাকা আসে, তাতে সামান্য লাভ থাকে।
পাউবোর তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন মৌসুমে উপজেলার হাজার হাজার কৃষক ধান, পাটসহ নানা ধরনের সবজি আবাদের জন্য গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্পের সেচের পানি দিয়েছেন। কিন্তু এবার সবগুলো পাম্প নষ্ট থাকায় পানি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে ঝিনাইদহ এবং মাগুরার কৃষকরাও এ পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
জানা গেছে, উপজেলার সাতব্রিজ এলাকায় প্রধান খালটি আলমডাঙ্গা সেচ খাল হিসেবে পরিচিত। পাউবো ভেড়ামারার পাম্প থেকে এ খালে পানি সরবরাহ করে। সেখান থেকে ৫টি শাখা খালের মাধ্যমে কৃষকের জমিতে সেচের জন্য পানি সরবরাহ করা হয়। তবে এবার পানি না দেওয়ায় খাঁ খাঁ করছে সেচ খালগুলো।
এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. শাহীন ইসলাম পাম্প বন্ধ হওয়ার কারণে এবার বোরো চাষে কৃষকদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। পাউবোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। পাম্পগুলো দ্রুত মেরামত করার চেষ্টা চলছে বলে তারা জানিয়েছেন। তবে কবে নাগাদ চালু হবে, সেটাও কর্তৃপক্ষ বলতে পারছে না।
ঝিনাইদহ জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাহিদুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, তিনটি পাম্পই বিকল হয়ে আছে। কবে নাগাদ সচল হবে সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না।
মন্তব্য করুন