ভারতীয় মহাসাগরে জলদস্যুর কবলে পড়া বাংলাদেশি এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজের ক্রু হিসেবে থাকা নাজমুলের মা (নার্গিস বেগম) ছেলের ছবি হাতে নিয়ে আহাজারি করে বলেছেন ‘আমার ছেলেক আনে আমার কাছে দেন। আমার ছেলেক আমি বুকের সঙ্গে আটকামু। আমার ছেলেক আনে দেন আপনারা, আমার একটাই দাবি। আমি আর কিছু চাই না, শুধু ছেলেক চাই। আগে আল্লাহ পরে আপনারা, এমপি-মন্ত্রী, সরকার যাই আছে তাদের কাছে আমার দাবি, আমার ছেলেডাক আমার কাছে আনে দেন। দুনিয়াত আল্লাহ আমাক একটা ছেলেই দিছে, ওইডা নিয়েই আমি দুনিয়াত আছি, আর তিনডা মরেই গেছে, এই ছেলেডা নিয়েই আমি দুনিয়াত থাকবার চাই।’
বুধবার (১৩ মার্চ) সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলার ভদ্রঘাট ইউনিয়নের নূরনগর গ্রামের নাজমুলের বাড়িতে গেলে নার্গিস বেগমকে ছেলের ছবি হাতে নিয়ে বিলাপ করতে দেখা যায়।
মাত্র ২৩ বছরের ছেলে মো. নাজমুল হক এলাকায় হানিফ নামেই বেশি পরিচিত। দুই ভাই-বোনের মধ্যে সে বড়। ছোটবেলাতেই মারা গেছে তার তিন ভাই-বোন। মাত্র ২০ বছর বয়সেই জাহাজে ক্রু হিসেবে চাকরি পাওয়ার সুবাদে পরিবারের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। জলদস্যুর কবলে পড়ার খবরে মা নার্গিস বেগমের মাথার ওপর যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। খবর শুনে বাবা আবু সামা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন মা। যে যাচ্ছে তার কাছেই কেঁদে কেঁদে সন্তানকে ফিরে পাওয়ার আকুতি জানাচ্ছেন।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে নার্গিস বেগম বলেন, ছেলে আমাকে ফোন দিয়ে বলেছে আম্মা আমাদেরকে সোমালিয়া জলদস্যুরা আটক করেছে। আমার জন্য তোমরা দোয়া কইরো, কোনো চিন্তা করো না। আর কথা নাও হতে পারে। এটাই হতে পারে শেষ কথা। বলেই ফোন কেটে দেয়। আর কথা হয়নি। ওর কিছু হলে আমরা কেউ বাঁচব না। বাবা-মা দুজনেই ওর সঙ্গে চলে যাব।
তিনি আরও বলেন, আমাদের এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। ছেলেই এখন ভরসা। ওর বাবা হার্টের রোগী, কোনো কাজ করতে পারে না। নাজমুলই আমাদের পরিবারের আয়ের একমাত্র অবলম্বন। তাই সরকারের কাছে দাবি আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দেন।
প্রতিবেশীরা জানান, আবু সামা ও নার্গিস বেগম দম্পতির একমাত্র অবলম্বন ছেলে নাজমুল। তিনি বাদুল্যাপুর মাল্টিপারপাস সায়েন্স অ্যান্ড টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে ২০১৭ সালে এসএসসি ও ২০১৯ এ এইচএসসি পাস করে। এরপর সিরাজগঞ্জ ইসলামীয়া সরকারি কলেজে অনার্সে পড়া অবস্থায় ২০২২ সালে জাহাজের ডেক ডিপার্টমেন্টের নাবিকের চাকরি নেয়। চাকরি নেওয়ার পর থেকেই হৃদরোগী বাবার মাথার ওপর থেকে পরিবারের বোঝাটা নামিয়ে নিজের কাঁধে নেয় নাজমুল।
মঙ্গলবার (১২ মার্চ) অন্যান্য নাবিকদের সাথে আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে ভারত মহাসাগর হয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাওয়ার পথে সোমালিয়ার জলদস্যুদের কাছে আটক হয় নাজমুল। খবর শুনেই এই পরিবারের সবাই অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। অনেক সেবা শুশ্রূষা করার পর তারা সুস্থ হয়। তার বাবা এখনো সুস্থ হয় নাই। তিনি হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। গ্রামে ১০টা ছেলে থাকলেও তাদের চেয়ে আলাদা এই ছেলেটা। তিন বছর ধরে চাকরি নিয়েছে। প্রথম টিপ দিয়ে আসার পরে দ্বিতীয় টিপে গিয়েছিল। সরকারের কাছে দাবি ছেলেটাকে যেন বাবা-মার কাছে সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে দেয়। নাজমুলের বন্ধু তারেক বলেন, আমরা গতকাল সন্ধ্যার পর জানতে পেরেছি। জেনে ওর মোবাইলে ম্যাসেজ দিয়েছি। ও ম্যাসেজ পাঠিয়েছে আমাদের আটকে রেখেছে। বাবা-মাকে বলো না। তারা কান্নাকাটি করবে। এটাই লাস্ট কথা হতে পারে। সরকারের কাছে দাবি নাজমুল যেন ফিরে আসে। ও খুব ভালো মানুষ।
নাজমুলের ফুপাতো ভাই আল মাহমুদ এসআর শিপ নামে জাহাজের নাবিক। তিনি ছুটিতে বাড়িতে রয়েছেন। তিনি বলেন, মঙ্গলবার ১টার দিকে সোমালিয়া থেকে আরব-আমিরাতের দিকে যাবে এমভি আব্দুল্লাহ শিপটি। তখনই শিপটাকে জলদস্যুরা আটক করেছে। ওরা একটি মোবাইল দিয়ে ভিডিও ধারণ করে। আমাদের সবার সাথে যোগাযোগের জন্য একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ আছে। ভিডিওটি সেই গ্রুপে দেয়।
তিনি বলেন, ভিডিও দেখার পরই শিওর হই ওই শিপে আমার মামাতো ভাই নাজমুল ছিল। যেহেতু এটি অফিসিয়াল ব্যাপার তাই বিষয়টি আমি বাড়িতে জানাইনি। সন্ধ্যার দিকে অফিস থেকেই বাড়িতে জানায় যে নাজমুল জলদস্যুদের হাতে আটক রয়েছে। ওর সাথে রাত ১১টা ২০ মিনিট পর্যন্ত যোগাযোগ করেছি। নাজমুল বলেছে তাদের সোমালিয়া দ্বীপে নিয়ে যাবে। আড়াইদিন সময় লাগবে। সকাল ৯টার দিকে এসআর শিপে আমি কথা বলি। স্যারের সাথে আমার কথা হয়েছে। স্যার বলেছেন ও ভালো আছে।
সিরাজগঞ্জ পুলিশ সুপার মো. আরিফুর রহমান মন্ডল বলেন, বিভিন্ন গণমাধ্যমে নাজমুলের বিষয়টি জানতে পেরেছি। তার পরিবার-স্বজনকে আশ্বস্ত করতে স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
মন্তব্য করুন