আমজাদ হোসেন শিমুল, রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশ : ২১ মার্চ ২০২৪, ০৯:৪৩ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

রাজশাহীতে ‘আ.লীগের চিরশত্রু আ.লীগ’ বিপরীত মেরুতে মেয়র-প্রতিমন্ত্রী ‘বলয়’

জনসভায় বক্তব্য দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। ছবি : কালবেলা
জনসভায় বক্তব্য দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। ছবি : কালবেলা

রাজশাহীতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রকাশ্যে দ্বি-খণ্ডিত হয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে কুৎসা রটাচ্ছে। এর এক বলয়ের নেতৃত্বে রয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। অপর প্রান্তের নেতৃত্বে রয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুল ওয়াদুদ দারা। কয়েক দিনের ব্যবধানে রাজশাহী শহরে পাল্টাপাল্টি সমাবেশ করে এক ‘বলয়’ অপর ‘বলয়’ এর নেতাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে গালাগালি করার মধ্য দিয়ে রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের চিরশত্রু হয়ে গেছে আওয়ামী লীগ।

সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (২১ মার্চ) ইফতারির আগ মুহূর্তে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে রাজশাহীর আওয়ামী লীগ থেকে ‘মীরজাফর ও মোস্তাকদের’ বিতাড়িত করার ঘোষণা দিয়েছেন দলটির নেতারা। এদিন বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বক্তারা এই ঘোষণা দেন। রাজশাহী মহানগরীর গণকপাড়া সংলগ্ন জয় বাংলা চত্বরে অনুষ্ঠিত এই সভার প্রধান অতিথি ছিলেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন।

এর আগে গত ৯ মার্চ একই স্থানে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মো. আবদুল ওয়াদুদ দারার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে রাজশাহীকে ‘মুক্ত’ ঘোষণা করা হয়েছে। রাজশাহী-১ (তানোর-গোদাগাড়ী) আসনের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে এই ঘোষণা দিয়েছেন। ওই দিনের সভায় বেশিরভাগ বক্তার বক্তব্যে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এ এইচ খায়রুজ্জামান লিটনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে। যদিও কেউ তার নাম উচ্চারণ করেননি। এসব বক্তব্যের ব্যাপারে খায়রুজ্জামান লিটন বলেছিলেন, ‘তারা যা করছে, ভবিষ্যৎ তার উত্তর দেবে।’

গত ৯ মার্চ প্রতিমন্ত্রী দারার সংবর্ধনা সভার প্রতিবাদ স্বরূপ গতকাল বৃহস্পতিবার লিটনের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হলো এই সভা। যেই সভায় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অনিল কুমার সরকার সভাপতিত্ব করেন। আর বিশেষ অতিথি ছিলেন মহানগরের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী কামাল, রাজশাহী-২ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ শফিকুর রহমান বাদশা, রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের সংসদ সদস্য মোহা. আসাদুজ্জামান আসাদ। এই সভা থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়, গত ৯ মার্চ পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী আবদুল ওয়াদুদ দারাকে যে স্থানে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে, সেই স্থানটিকে ‘পবিত্র’ করা হবে। এ জন্য সেখানে ইসলামী জালসার আয়োজন করে দোয়া-কালাম পড়া হবে। গত ৯ মার্চ নগরীর সাহেববাজার বড় মসজিদ প্রাঙ্গণে প্রতিমন্ত্রী হওয়ায় রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনের এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াদুদ দারাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের ব্যানারেই ওই সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয়।

ওই অনুষ্ঠানে রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনের এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী রাজশাহীর আওয়ামী লীগকে ‘রাহুমুক্ত’ করার ঘোষণা দেন। বৃহস্পতিবারের আলোচনা সভায় এসবের তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়।

সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রতিমন্ত্রী দারাকে উদ্দেশ্য করে খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ‘একজন কিছু একটা হয়ে গেছেন, তাকে সংবর্ধনা দিতেই পারেন। লোক ভাড়া করে আনা হলো, সাহেববাজার বড় মসজিদ প্রাঙ্গণটিকে কলুষিত করা হলো।’ সংগঠনের নামে আমরা দেখলাম অন্যকে গালাগালি করে ছোট করার অপপ্রয়াস করা হলো।

এমপি ওমর ফারুক চৌধুরীর প্রতি ইঙ্গিত করে লিটন বলেন, ‘দেখলাম, সেই মঞ্চে যার গায়ে ছাত্রদলের গন্ধ, যার গায়ে ফ্রিডম পার্টির গন্ধ, যার পরিবারে এখনও স্বাধীনতার বিপক্ষের মানুষের চলাচল আছে, যার নিজের এলাকায় তাকে গডফাদার বলা হয়, কীসের গডফাদার আমি সেটা বলতে চাই না। তিনি ঘোষণা করলেন- রাজশাহীর আওয়ামী লীগকে জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হলো। আরে উনি তো নিজেই ছাত্রদল ফ্রিডম পার্টি করে এসেছেন, উনি আবার আওয়ামী লীগকে রাহুমুক্ত করবেন কীভাবে! আমরা জন্মগতভাবে রক্তের মধ্যে দিয়েই আওয়ামী লীগ করি।’

লিটন বলেন, ‘আমরা মনে করি, বড় মসজিদ প্রাঙ্গণ সেটাকে কলুষিত করার জন্য সেখানে মিলাদ দিয়ে পবিত্র করা দরকার। আমরা সেটা করতে চাই। ঈদের পরেই আমরা সেখানে ইসলামি জালসা দিয়ে মওলানাদের ডেকে এনে, দোয়া-কালাম পড়িয়ে পবিত্র করতে চাই। কারণ, কিছু রাজাকার, কিছু বিএনপি, জনগণের ভোটে তারা কতটুকু এগিয়ে আছেন আমি সে প্রশ্নে যাব না। তারা ওখানে বড় বড় কথা বলে আমাকে, আমাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে।’

সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের এমপি আসাদুজ্জামান আসাদ। তিনি বলেন, ‘কিছুদিন আগে কিছু রাজাকারশাবক রাজশাহীকে অশান্ত করতে এসেছিল। তারা খায়রুজ্জামান লিটনের পায়ের নিচে বসে নেতা হয়েছে। যারা কয়দিন আগে জিন্দাবাদ স্লোগান দিয়েছে, তারা এখন নোংরা কথা বলবে এটাই স্বাভাবিক। রাজাকারশাবকদের বলব, যদি সাহস থাকে, ক্ষমতা থাকে কোথায় সমাবেশ করবেন জানাবেন। সেখানে গিয়ে ওই মঞ্চে দাঁড়িয়েই আপনাদের মুখোশ উন্মোচন করতে চাই।’

আলোচনা সভায় অন্যদের মধ্যে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বেগম আখতার জাহানও বক্তব্য দেন। সভা পরিচালনা করেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক লায়েব উদ্দিন লাভলু ও মহানগরের যুগ্ম সম্পাদক মোস্তাক হোসেন। সভায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের আরও অনেক নেতা বক্তব্য দেন। তারাও ‘ষড়যন্ত্রকারীদের’ রাজশাহী থেকে বিতাড়িত করার ঘোষণা দেন।

এর আগে গত ৯ মার্চ বিকেলে রাজশাহী নগরের সাহেববাজার বড় মসজিদ চত্বরে রাজশাহী জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের ব্যানারে প্রতিমন্ত্রী আব্দুল ওযাদুদকে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী। ঢাকা থেকে ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেন সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ, রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আয়েন উদ্দিন, রাজশাহী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর ইকবাল, রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ইব্রাহিম হোসেন, সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার প্রমুখ।

ওই দিনের অনুষ্ঠানে সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী স্বাগত বক্তব্য দিতে উঠেই বলেন, ‘আজ থেকে রাজশাহী জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ মুক্ত বলে ঘোষণা করা হলো। রাজশাহীর আকাশে যে অমাবস্যা ছিল, সব সময়ই অমাবস্যা, সব সময়ই সূর্যগ্রহণ, আজকে থেকে আর কোনো সূর্যগ্রহণ রাজশাহীর আকাশে কাজ করবে না। আমরা করতে দেব না। আমরা জননেত্রী শেখ হাসিনার সৈনিক। আমরা আওয়ামী লীগকে সমস্ত রকম অন্যায়-অবিচার থেকে মুক্ত ঘোষণা করলাম।’

মেয়র খায়রুজ্জামান লিটনের প্রতি ইঙ্গিত করে ওমর ফারুক চৌধুরী আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আজকে সকল মানুষকে ফিরিয়ে দেওয়া হলো এবং একে (রাজশাহী) মুক্ত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হলো। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী মাথা উঁচু করে চলবে। কারণ, জননেত্রী শেখ হাসিনা এ দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, তিনি ছাড়া আর কোনো বাঘ আমরা দেখতে চাই না। আমরা মাননীয় মন্ত্রীর (প্রতিমন্ত্রী আবদুল ওয়াদুদ) নেতৃত্বে একত্রিত হয়ে একসঙ্গে পথ চলব এবং আমরা শহর ও জেলাতে সবার জন্য জাস্টিস কায়েম করব। কারও একক নেতৃত্বের এলাকা এই রাজশাহী নয়। সুতরাং আমরা এটি মানব না। আমরা আজকে প্রথম ট্রায়াল করলাম এবং এরপরে আমরা আরও অনেক কিছু দেখাব বলে প্রত্যাশা করছি।’

সাবেক সংসদ সদস্য আয়েন উদ্দিনও তার বক্তব্যে মেয়র লিটনের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, ‘একক নেতৃত্বে রাজশাহী সংগঠিত হয়নি। তিনি একটি জিনিস বিশ্বাস করতে পারেন না যে আমার সঙ্গে থাকলে সে সঙ্গী, আর না থাকলে সে জঙ্গি হয়ে যাবে। এই মনোভাব রাজশাহীতে আছে। আমার সঙ্গে থাকলে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের লোক হয়, আর আমার সঙ্গে না থাকলেই রাজাকারের সন্তান হয়, এটি কিন্তু রাজশাহীতে আছে।’

আর ওই দিন প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রতিমন্ত্রী আবদুল ওয়াদুদ বলেছিলেন, ‘ফারুক ভাই বললেন, রাজশাহী জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ আজ মুক্ত হলো। কেন বললেন এ কথাটি, তার সারমর্ম রয়েছে। কী এমন রাজনৈতিক নেতা, আমার আসনে নৌকার বিরুদ্ধে এত ভোট পায়? তার রাজনৈতিক পরিচয় কী? একটাই কারণ, তার টাকা আর তার পেছনে রাজনৈতিক মহাশক্তি। পুঠিয়া-দুর্গাপুরে কে আছে এত যোগ্য? আমি নিজের কথা বলছি না। দুঃখে, কষ্টে, যন্ত্রণায় বলছি। আমার পুঠিয়া-দুর্গাপুরের বহু নেতাকে এই শহরের কিছু নেতা মুনাফেক বানিয়েছে, বেইমান বানিয়েছে, চরিত্র হনন করেছে।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ধেয়ে আসছে অতি ভারী বৃষ্টিবলয় ‘স্পিড’, কবে কোথায় প্রভাব ফেলবে

এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ নিয়ে যে সিদ্ধান্ত নিল ভারত সরকার

ইমিগ্রেশনের সময় যে ৭ কথা বললেই মহাবিপদ

সাগর-রুনির সন্তান মেঘের হাতে পূর্বাচলের প্লটের দলিল হস্তান্তর

৮ মামলায় ইমরান খানের জামিন

মাদ্রাসাপ্রধানদের জন্য অধিদপ্তরের জরুরি নির্দেশনা, না মানলে ব্যবস্থা

বরাদ্দ পেল বগুড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

স্থিতিশীল অর্থনীতির জন্য গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর দাবি ব্যবসায়ীদের

কক্সবাজার যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা

যে বয়সের আগেই শিশুকে ৮ শিক্ষা দেওয়া জরুরি

১০

দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীকে ‘চাঁদাবাজ’ আখ্যা প্রধান শিক্ষকের, তদন্তে কমিটি

১১

চট্টগ্রাম-৩ আসনে ধানের শীষের মনোনয়নপ্রত্যাশী মিল্টন ভুঁইয়া

১২

বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা নিয়ে ‘সুখবর’ পাচ্ছেন শিক্ষক-কর্মচারীরা

১৩

ফেসবুক পেজ জনপ্রিয় করার ৮ কৌশল

১৪

বাড়ির আঙিনায় বিষধর পদ্মগোখরা, অতঃপর...

১৫

মোবাইল দিয়েই ডিএসএলআর ক্যামেরার মতো ছবি তোলার ৫ কৌশল

১৬

বরইতলা নদীর ‘বাঁধ’ এখন মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর

১৭

ইস্পাত খাতে বিশেষ তহবিল চান ব্যবসায়ীরা

১৮

বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধিতে আগ্রহী পাকিস্তান

১৯

উপকূলজুড়ে টানা বৃষ্টিপাত, জনজীবনে দুর্ভোগ

২০
X