বসন্তে যে ফুলগুলো প্রকৃতিতে মনোমুগ্ধকর করে তোলে তাদের মধ্যে মান্দার বা পারিজাত অন্যতম। কথিত স্বর্গীয় ফুল মান্দারের অগ্নিসদৃশ লাল রঙ মানুষকে যেমন মুগ্ধ করে তেমনি মুগ্ধ করে বিভিন্ন পাখিকে। তাই বৃক্ষ জাতীয় সপুষ্পক উদ্ভিদ মান্দার বা পারিজাত গাছে বসন্তে যেন পাখিদের মিলন মেলা বসে।
পারিজাত ফুল নিয়ে কবি লেখকরা লিখেছেন অনেক গান, কবিতা। সাহিত্যে ঠাঁই হলেও কাঁটাযুক্ত মাঝারি আকৃতির দেশি মান্দারের ঠাঁই হচ্ছে না আমাদের দেশে। পারিজাতের আদি নিবাস গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চল ও মিয়ানমার। বাংলাদেশের দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব ও মধ্যাঞ্চল ছাড়াও অনেক এলাকায় কম বেশি মান্দার গাছ দেখতে পাওয়া যায়। তবে, ক্রমেই কমছে এ গাছের সংখ্যা। সময়ের স্রোতে হারিয়ে যাচ্ছে চোখ ধাঁধানো পারিজাত বা মান্দার ফুল।
ইরিথ্রিনা গণভুক্ত মান্দার বা পারিজাত ফুলের বৈজ্ঞানিক নাম Erythrina variegata. ইরিথ্রিনা গণভুক্ত উদ্ভিদগুলো মাদার বা মান্দার নামে পরিচিত। বিভিন্ন এলাকার মানুষ ভিন্ন ভিন্ন নামে এ ফুলকে চেনেন। এলাকা ভেদে কেউ এ ফুলকে মাদার, কেউ মান্দার, কেউবা কাঁটা মান্দারও বলে থাকেন। কেউ কেউ ডাকেন অন্য নামে।
ধূসর রঙের শাখা বিশিষ্ট মান্দার গাছ প্রায় পনেরো বিশ মিটার উঁচু হতে পারে। শীত কাল শুরুর দিকে এ গাছের পাতা ঝড়ে যায়। এসময় গাড় লাল রঙের গন্ধহীন ফুলে ছেয়ে যায় মাদার গাছ। শাখার অগ্রভাগে ফুলের মঞ্জরি হয়। এক একটি মঞ্জরিতে কয়েকটি ফুল হয়। মার্চ-এপ্রিলে গাছে নতুন পাতা গজায়।
গ্রাম এলাকায় এখন খুব কম সংখ্যক মান্দার গাছ চোখে পরে। বহু বছর বেঁচে থাকে বলে কেউ কেউ জমির আইল চিহ্নিত করে রাখার জন্য মান্দার গাছের শাখা লাগান। কেউ কেউ বাড়ির চার পাশের বেড়া দিতে খুঁটি হিসেবে মান্দার গাছ লাগিয়ে থাকেন। কেউ কেউ মাছ ধরার উদ্দেশ্যে নদী জলাশয়ের স্বল্প পানিতে মান্দার গাছ ফেলে রাখেন। নিরাপদ আবাস ভেবে পানিতে ফেলে রাখা মান্দার গাছের মধ্যে মাছ বসবাস করতে শুরু করে। কয়েক দিন পর পর মানুষ পানিতে ফেলে রাখা মান্দার গাছের চারপাশ জাল দিয়ে ঘিরে মাছ ধরেন। অন্যান্য কাঠের মতো দামি না হওয়ায় অনেকে মান্দার গাছ লাগাতে উৎসাহী হন না। অল্প কিছু সৌখিন মানুষ ফুলের প্রতি ভালোবাসার স্মারক হিসেবে এবং সৈন্দর্য বাড়াতে বাড়ির সামনে মান্দার গাছ লাগান। পারিজাতের সৈন্দর্যে মুগ্ধ হন কিশোর-কিশোরীসহ নানা বয়সী মানুষ।
হিন্দু পুরাণ মতে, অমৃতের সন্ধানে দেবতা ও অসুররা সমুদ্র থেকে অনেক আশ্চর্য বস্তু তুলে এনেছিলেন। সমুদ্র মন্থনে ওঠে আসা সেই আশ্চর্য বৃক্ষের নাম পারিজাত। তাই স্বর্গের বর্ণনায় এ বৃক্ষের নাম ওঠে এসেছে বারবার। ইন্দ্রের বাগানেরও প্রধান গাছ ছিল এই পারিজাত। পুরাণে পারিজাতকে কল্পতরু হিসেবে অভিহিত করা হয়।
চাটমোহর পৌর সদরের উদ্ভিদপ্রেমী বায়েজীদ বোস্তামী জানান, ভেষজগুণ সম্পন্ন মান্দার নামক এ উদ্ভিদ কেউ চাষ করে না। বন জঙ্গলে প্রাকৃতিকভাবেই জন্মে এবং অযত্ন অবহেলায় বেড়ে ওঠে। উপকূলীয় যেসব এলাকায় জোয়ার-ভাটা আসা যাওয়া করে সেসব এলাকায় মান্দার গাছের আধিক্য দেখা যায়। দেশের অন্যান্য এলাকায় এ গাছ খুব একটা চোখে পরে না।
পরিণত বয়সের মান্দার গাছ চিরে দয়াশলাই এর শলাকা তৈরি ও ইটের ভাটার জ্বালানি কাঠ হিসেবে মান্দার গাছ ব্যবহার করায় পরিণত বয়ষ্ক মান্দার গাছ এখন আর প্রায় চোখে পরে না বললেই চলে। সময়ের বিবর্তনে মূল্যের প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে সাহিত্য, পুড়াণে স্থান পাওয়া পারিজাত বা মান্দার হয়ে উঠছে দুর্লভ বৃক্ষ ও ফুল।
মন্তব্য করুন