কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৬ জুলাই ২০২৫, ০৬:৩৮ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

দুঃখজনকভাবে বিচার বিভাগ এখনো নির্বাহী বিভাগের উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল : বিজেএসএ

বিজেএসএর লোগো। ছবি : সংগৃহীত
বিজেএসএর লোগো। ছবি : সংগৃহীত

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগের সক্ষমতা ও স্বাধীনতা অপরিহার্য হলেও, দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ এখনো নির্বাহী বিভাগের উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল মন্তব্য করেছেন জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) সদস্যরা। তারা বলেছেন, বিচারকদের পদ বৃদ্ধি, পদ সৃজন এবং আদালতের অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগের হাতে থাকায় বিচারিক কর্মঘণ্টার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না, যা বিচারিক প্রক্রিয়াকে শ্লথ করে দিচ্ছে।

ময়মনসিংহ বিভাগের ৪ জেলাসহ কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও গাজীপুরে কর্মরত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) ‘জুলাই বিপ্লবের অঙ্গীকার ও পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয়’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় শনিবার (২৬ জুলাই) তারা এমন দাবি করেন।

সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ময়মনসিংহ জেলার সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মো. জাকির হোসেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি, খুলনার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. আমিরুল ইসলাম (জেলা ও দায়রা জজ)। এছাড়াও শেরপুর, নেত্রকোনা, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ জেলার সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ এবং গাজীপুর মহানগর দায়রা জজ, বিজেএসএ মহাসচিব মুহাম্মাদ মাজহারুল ইসলাম প্রমুখ সভায় উপস্থিত ছিলেন।

সভার শুরুতে বিচারকরা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদ ও আহতদের স্মরণ করেন। বক্তারা তাদের আত্মত্যাগকে গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় একটি নতুন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করেন। তারা জোর দিয়ে বলেন, এই আত্মত্যাগ শোষণ, নিপীড়ন, বৈষম্য এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এক অবিস্মরণীয় লড়াইয়ের অংশ। সভায় উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে জেলা আদালতের বিচারকদের প্রতি বৈষম্যের বিষয়টি তীব্রভাবে উঠে আসে। আলোচকরা উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে জেলা আদালতের বিচারকদের জন্য ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন। বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন এ লক্ষ্যে জ্যেষ্ঠতা, মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে জেলা আদালত থেকে সমতা রক্ষা করে বিচারক নিয়োগের দাবি জানিয়েছেন।

এছাড়াও, বিচার বিভাগের বাজেট সংকট এবং নির্বাহী বিভাগের উপর পূর্ণ নির্ভরতা বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে খর্ব করছে বলে বক্তারা উল্লেখ করেন। অর্থনৈতিক দুর্বলতা আদালতের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও বিচারিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করছে। উপস্থিত বিচারকরা বিচার বিভাগের জন্য একটি পৃথক বাজেট কাঠামো এবং স্বাধীন বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার অপরিহার্যতা তুলে ধরেন। তারা বলেন, বিচারকরা সংবিধান রক্ষার গুরুদায়িত্ব পালন করেন, তাই তাদের মর্যাদা ও আর্থিক প্রণোদনাও সে দায়িত্বের সমতুল্য হওয়া উচিত। বক্তারা ২০০৯ সালের স্কেলে স্থবির হয়ে থাকা জুডিশিয়াল ভাতার অচলাবস্থারও সমালোচনা করেন এবং একটি পৃথক ও স্বাধীন পে-কমিশন গঠনের দাবি জানান।

বক্তারা বলেন, বিচার বিভাগের উপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বিচারকদের বদলি, নিয়োগ, পদায়ন এবং শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিষয়াবলী বহুলাংশে নির্বাহী বিভাগের হাতে ন্যস্ত থাকায় শাসকশ্রেণি ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বিচারিক প্রক্রিয়ায় অযাচিত প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে, যা জনগণের মধ্যে বিচার বিভাগের প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি করে। এই সংকট নিরসনে বিচার বিভাগের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা এবং নির্বাহী ও আইনসভা থেকে এর কার্যকর পৃথকীকরণ অত্যন্ত জরুরি বলে বক্তারা মনে করেন।

উপস্থিত বিচারকমণ্ডলী জোর দিয়ে বলেন, বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অধীনে একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণকে রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলনীতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৯৫ সালের ঐতিহাসিক মাজদার হোসেন মামলার রায়ে হাইকোর্ট বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার নির্দেশনা দেন, যা আপিল বিভাগ ১৯৯৬ সালে বহাল রাখেন। ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর বিচার বিভাগকে পৃথক ঘোষণা করা হলেও রায়ের ১২ দফার মধ্যে একটি মাত্র পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়েছে। বিচার বিভাগের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, পৃথক সচিবালয় বা বিচারকদের শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিষয়গুলো এখনো সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। তারা আরও বলেন, সংবিধানের ১০৯ ও ১৬৬ক অনুচ্ছেদ অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের উপর হাইকোর্টের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা এবং বিচারিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করলেও, ১১৬ অনুচ্ছেদ বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করেছে, যা নির্বাহী বিভাগের পরামর্শে প্রয়োগ হয়। এর ফলে বিচারকদের পোস্টিং, পদোন্নতি এবং শৃঙ্খলামূলক বিষয়গুলো এখনো নির্বাহী বিভাগের অধীনে রয়ে গেছে, যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার মূলনীতিকে ব্যাহত করছে। বক্তারা ১১৬ অনুচ্ছেদের পরিবর্তন করে এই ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের হাতে ন্যস্ত করার এবং একটি পৃথক ‘বিচার বিভাগীয় সচিবালয়’ গঠনের আহ্বান জানান।

বিচারকরা আশা প্রকাশ করেন, বর্তমান প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ বিচার বিভাগের সংস্কারে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। ২০২৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তিনি অধস্তন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত অভিভাষণে বিচার বিভাগের জন্য যে ঐতিহাসিক রোডম্যাপ তুলে ধরেন তার উদ্ধৃতি দিয়ে বিচারকরা দাবি করেন, সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ এখতিয়ার সম্পূর্ণরূপে বিলোপ কতে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে অনতিবিলম্বে একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এছাড়াও, সুপ্রিম কোর্ট বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ, ২০১৫ প্রণীত হয়েছে এবং প্রধান বিচারপতি নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের মতো বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেছেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় গঠনের বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিএনপিই একমাত্র দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফেরাতে পারে : অমিত

ট্রেন থেকে পড়ে অজ্ঞাত ব্যক্তি নিহত

মাদক বিক্রি বন্ধের প্রতিবাদে হামলা, চিকিৎসাধীন ইমন দাশের মৃত্যু

ওসমান হাদিকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সিঙ্গাপুর পাঠানো হবে

শুরু হচ্ছে পুষ্টি ভার্সেস অফ লাইট সিজন-২ কোরআন প্রতিযোগিতা

হাদিকে গুলি : আদালতে যা বললেন সেই মোটরসাইকেলের মালিক

রাবিতে শীতকে বরণ করে নিতে শিক্ষার্থীদের ব্যতিক্রমী আয়োজন

শহীদ বুদ্ধিজীবীরা দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক মেরুদণ্ড ছিলেন : চসিক মেয়র

ওমরাহ করানোর কথা বলে ভোট চাইলেন জামায়াতের প্রার্থী

চট্টগ্রামে আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলন ১৮ ডিসেম্বর

১০

সিডনিতে হামলা / সন্দেহভাজন গুলি করা ব্যক্তি পাকিস্তান থেকে এসেছেন

১১

নিজামী ও গোলাম আযমকে ‘সূর্যসন্তান’ বলে শিবির নেতার বক্তব্য, অতঃপর...

১২

রাজধানীতে যাত্রীবাহী বাসে আগুন

১৩

ভারতীয় আগ্রাসনের প্রতিবাদে সর্বদলীয় প্রতিরোধ সমাবেশের ডাক

১৪

মেডিকেলে দ্বিতীয় নাবিহা

১৫

বিজয়ের মাসে জাতীয় পতাকা বিক্রিতে ভাটা, মৌসুমি ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত

১৬

অটোরিকশায় যাত্রী বেশে ব্যবসায়ীর ১০ লাখ টাকা নিয়ে গেল ছিনতাইকারী

১৭

আনিস আলমগীর জানালেন, তিনি ডিবি কার্যালয়ে

১৮

ঢাকাস্থ রাজশাহী বিভাগ সাংবাদিক সমিতির সভাপতি রিয়াজ ও সম্পাদক দীপক

১৯

চট্টগ্রামে বিজয় মেলার উদ্বোধন

২০
X