ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) জগন্নাথ হলে সাবেক শিক্ষক ও প্রখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন বোসের নামে প্রতিষ্ঠিত সত্যেন বোস পাঠাগারে ভাঙচুর ও লুটপাট করে পাঠাগার সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের মারধর ও লাঞ্ছিত করার অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলটির কিছু শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে। গত ২ সেপ্টেম্বর রাতে এই ঘটনা ঘটেছে বলে জানা যায়।
সত্যেন বোস পাঠাগারের সম্পাদক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মোজাম্মেল হক এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী ও জগন্নাথ হল বিতর্ক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পিংকর চৌধুরী রাতুল এবং টুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী রাজদীপ চৌধুরী রানুসহ কয়েকজনকে অভিযুক্ত করেছেন। তার দাবি, অভিযুক্তরা ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
তাছাড়া খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাতুল সরাসরি ছাত্রলীগের কোনো পদে না থাকলেও জগন্নাথ হল ছাত্রলীগের সভাপতি কাজল দাশের গ্রুপে কর্মী হিসেবে রাজনীতি করতেন। অন্যদিকে, রানু হল ক্যান্ডিডেট সুস্ময় রায় ও মিঠু চন্দ্র শীলের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতের রাজনীতি করতেন।
গতকাল বুধবার (০৪ সেপ্টেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে ঘটনার সার্বিক বিষয়ে জানিয়ে পাঠাগারের সম্পাদক মোজাম্মেল হক একটি সংবাদ সম্মেলনও করেছেন। তিনি আজ (বৃহস্পতিবার) কালবেলাকে বলেন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার উদ্যোগে এবং ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের পরিচালনায় ১৯৯৮ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক, প্রখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন বোসের নামে 'সত্যেন বোস পাঠাগার' পরিচালিত হয়ে আসছে। দীর্ঘদিন ভাসমান থাকার পর শিক্ষার্থীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৪ সালে তৎকালীন প্রভোস্টের সহযোগিতায় পাঠাগারটি জগন্নাথ হলে একটি কক্ষ বরাদ্দ পায়। পাঠাগারটি দীর্ঘদিন ধরেই বই পড়া কর্মসূচী, পাঠচক্র, আলোচনা সভা, সিনেমা প্রদর্শনী, মনীষী স্মরণ, শীতার্তদের মাঝে বস্ত্র বিতরণ, বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানো, বুক স্টল দেয়াসহ নানা ধরনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক কার্যক্রম চালিয়ে আসছে; যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনা তৈরিতে ভূমিকা পালন করেছে।
তিনি বলেন, সম্প্রতি ছাত্রজনতার অভ্যুত্থান চলাকালে হল বন্ধ ঘোষণার সময় পাঠাগারটি প্রশাসন তালাবদ্ধ করে রাখে। গত ০২ সেপ্টেম্বর রাতে পিংকর চৌধুরী রাতুল ও রাজদীপ চৌধুরী রানুর নেতৃত্বে ছাত্রলীগের কিছু কর্মী পাঠাগারটির তালা ভেঙে কিছু জিনিসপত্র নিয়ে যায়। আমাকে ফোন করে হুমকি প্রদান করে, অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে, জগন্নাথ হলে গিয়ে তাদের সাথে দেখা করতে চাপ প্রদান করে। এই পরিস্থিতিতে পাঠাগারের সঙ্গে যুক্ত জগন্নাথ হলের কয়েকজন শিক্ষার্থী তাদের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তারা উত্তেজিত মব তৈরি করে তাদের লাঞ্চনা করে, আটকে রেখে দীর্ঘসময় জেরা করে ও মারধর করে। এ সময় মবের মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে কিছু শিক্ষার্থী তাদের রক্ষায় এগিয়ে আসে। আমি তাদের সাহসী ভূমিকার জন্য অকুণ্ঠ ধন্যবাদ জানাই।
মোজাম্মেল আরও বলেন, হল প্রাধ্যক্ষের উপস্থিতিতে ছাত্রলীগের উত্তেজিত কর্মীরা তাদের ফোন চেক করে, ওই সময় অন্যদের সঙ্গে তাদের ফোনালাপ লাউড দিয়ে মবকে শোনায়, যা রীতিমতো মানবাধিকার লঙ্ঘন। সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানে শত শত মানুষের শহীদি আত্মদানে পাওয়া বাংলাদেশে এ ধরনের অসহিষ্ণু এবং অগণতান্ত্রিক আচরণ আমাদের ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করেছে। পরে, একজন সহকারী প্রক্টর ও প্রশাসনের সহযোগিতায় পাঠাগারের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার্থীরা নিরাপদ আশ্রয়ে যায়।
হলের সাবেক প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মিহিত লাল সাহাকে দোষারোপ করে তিনি বলেন, গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে পরাজিত শক্তি ছাত্রলীগ হল প্রভোস্ট মিহির লাল শাহার সহযোগিতায় এরকম একটি ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটালো। আমরা আগেও দেখেছি তিনি নানাভাবে ছাত্রলীগকে শেল্টার দিয়েছেন এবং নানা অপকর্মে ছাত্রলীগকে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন। এ ছাড়া এই হামলায় হাউস টিউটর অধ্যাপক নেপাল চন্দ্র রায়ের যুক্ততার প্রমাণও পাওয়া গেছে। একজন শিক্ষক এবং প্রভোস্টের পক্ষ থেকে এ রকম আচরণ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের দমনপীড়নের বিরুদ্ধে ছাত্রজনতার রক্তাক্ত অভ্যুত্থান একটি বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষাকে জাগ্রত করেছে। আমরা প্রত্যেকেই চাই, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অগণতান্ত্রিক এবং অসহিষ্ণু পরিবেশ তৈরি না হোক।
মানবাধিকার ও সমাজকর্মী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন বলেন, জগন্নাথ হলে সত্যেন বোসের নামানুসারে ‘সত্যেন বোস পাঠাগারে’ ভাঙচুর হয়েছে। এর নিন্দা জানানোর ভাষা আমার জানা নাই। যেই সংগঠন এই পাঠাগারটি পরিচালনা করে তাদের একজন নেতা আমাকে জানিয়েছে এই অপকর্মটি নাকি ছাত্রলীগ করেছে।