এক সময়ের টিলাময়, শান্তপ্রকৃতির এক গ্রাম। যেখানে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙা এক নিসর্গ। সেখানেই এখন জ্ঞানচর্চার এক আলো ঝলমলে ঠিকানা— কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। আজ সে বিশ্ববিদ্যালয়ের পথচলার ২০ বছরে পদার্পণ হলো। ২০০৬ সালের ২৮ মে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এই প্রতিষ্ঠান আজ শুধু দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের নয়, পুরো বাংলাদেশের শিক্ষা-মানচিত্রে একটি গর্বিত নাম।
শুরুটা ছিল নেহাতই সাদামাটা। মাঠের ঘাসে পা ফেলে ক্লাসে যাওয়ার দিন, কাঁচা সড়কে ধুলোমাখা সাইকেলের শব্দ, সীমিত ভবন আর সীমাহীন স্বপ্নে গড়া এক ছোট্ট কাঠামো। মাত্র ১৫ জন শিক্ষক ও ৩০০ শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল যেই প্রতিষ্ঠানটির, আজ সেখানে কয়েকশত শিক্ষক, কয়েক হাজার শিক্ষার্থী, দৃষ্টিনন্দন অ্যাকাডেমিক ভবন, গবেষণাগার, লাইব্রেরি— সব মিলিয়ে এক প্রগতিশীল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিপূর্ণ রূপ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ইট, প্রতিটি গাছপালা, প্রতিটি করিডোর যেন কথা বলে। ছাত্রছাত্রীদের পদচারণায় মুখর এই প্রাঙ্গণে কেবল পাঠদানই নয়, প্রতিনিয়ত জন্ম নিচ্ছে নতুন চিন্তা, নতুন প্রশ্ন, নতুন সম্ভাবনা। এখানকার শিক্ষার্থীরা আজ দেশবিদেশের নানা অঙ্গনে নিজেদের মেধা ও মননের ছাপ রাখছে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন শুধু পরীক্ষার ফলাফলে সীমাবদ্ধ নয়— এটি বিস্তৃত বিতর্ক, গবেষণা, সমাজসেবা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ক্ষেত্রেও।
যারা এক সময় রোদ-বৃষ্টির মধ্যে হেঁটে হেঁটে ক্লাসে যেতেন, আজ তারা আধুনিক অ্যাকাডেমিক ভবনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করছেন বা নিচ্ছেন। গবেষণার সুযোগও বেড়েছে বিস্তর। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যৌথভাবে গবেষণা করছেন দেশের গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক, পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে। আন্তর্জাতিক গবেষণা জার্নালগুলোতে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম এখন পরিচিত।
এতকিছুর পরেও অপূর্ণতা থেকে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা। কিন্তু সেই অনুসারে নেই শিক্ষক। কয়েকটি বিভাগে এখনো রয়েছে শিক্ষক স্বল্পতা। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের পূর্ণতা পেতে পাড়ি দিতে হবে আরও বহু পথ।
একটি বিশ্ববিদ্যালয় কেবল পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, সেটি হয়ে ওঠে একটি চিন্তাশীল সমাজের সূতিকাগার। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ও ঠিক তেমনই এক জায়গা, যেখানে শিক্ষার্থীরা যেমন শিক্ষা গ্রহণ করে, তেমনি গড়ে তোলে নিজেদের মূল্যবোধ, নেতৃত্বের গুণাবলি এবং মানবিক অনুভূতি। তাইতো এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগে যেমন রক্তদান, শীতবস্ত্র বিতরণ, ত্রাণ তৎপরতা বা জলবায়ু সচেতনতায়ও এগিয়ে আসে নির্দ্বিধায়।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এই লাল মাটির ক্যাম্পাস। নিজের রক্ত দিয়ে ইতিহাস লিখেছে নিজের নাম। শহীদ হন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের শিক্ষার্থী আবদুল কাইয়ুম। আহত হন হাজারো শিক্ষার্থী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক চর্চাও উল্লেখ করার মতো। এখানে রয়েছে নাট্যদল, সংগীতচক্র, আলোকচিত্র সংগঠন, সাহিত্যের আসর— যেগুলো শিক্ষার্থীদের মেধা ও সৃজনশীলতার বিকাশে অবিচ্ছেদ্য ভূমিকা রাখে। এখানকার প্রতিটি অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই হয় আয়োজক, উপস্থাপক এবং মূল নায়ক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন পরিকল্পনায় রয়েছে ভবিষ্যতের জন্য ব্যাপক উদ্যোগ। শুধু অবকাঠামো নয়, শিক্ষা ও গবেষণায় গুণগত মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছে নানামুখী পদক্ষেপ। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য, ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট, উদ্যোক্তা দক্ষতা এবং বৈশ্বিক যোগাযোগে দক্ষ করে তুলতে সচেষ্ট।
প্রতিষ্ঠাকালীন কর্মকর্তা ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার মোশাররফ হোসেন কালবেলাকে বলেন, ২০০৬ সালে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শুরুতে ৫০ একর ভূমি ছিল দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল। তৎকালীন সময়ে আমরা প্রাথমিকভাবে প্রায় ছয় মাস ঢাকার সিদ্ধেশ্বরীর লিয়াজোঁ অফিস থেকে প্রশাসনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাই। অবশেষে ২০০৭ সালের ২৮ মে শিক্ষার্থীদের পদচারণায় সেই অনুজ্জ্বল ভূমিটি প্রাণ ফিরে পায় এবং হয়ে ওঠে এক উর্বর জ্ঞানভূমি। মাত্র ৩০০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় আজ ৭১৩০ জন শিক্ষার্থীর একটি পূর্ণতা অর্জনের দ্বারপ্রান্তে। লাল মাটির এই প্রিয় ক্যাম্পাসটি তার অগ্রযাত্রায় সদা সচল থাকুক, শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে ও গবেষণায় পৌঁছাক অনন্য উচ্চতায়।
প্রতিষ্ঠাকালীন শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এম এম শরিফুল করীম বলেন, স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা যোগ দিই ৬ মে, আর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ২৮ মে ২০০৭ সালে। শুরুটা ছিল মাত্র ১৫ জন শিক্ষক, ৭টি বিভাগ ও ৩০০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে। আজ আমরা অনেক দূর পথ অতিক্রম করেছি। আমি আশাবাদী, ভবিষ্যতে আমাদের শিক্ষার্থীরা আরও উচ্চতর স্থানে পৌঁছাবে— এটাই আমাদের বিশ্বাস, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
প্রতিষ্ঠাকালীন আরেক শিক্ষক ও বর্তমান কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সোলায়মান বলেন, লাল মাটির প্রিয় ক্যাম্পাস কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় আজ পা রাখল তার ২০তম বছরে। সাতটি বিভাগ নিয়ে যে ক্ষুদ্র যাত্রার সূচনা, আজ তা বিস্তৃত হয়েছে ১৯টি বিভাগে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে, গড়ে উঠেছে দেশবিদেশে ছড়িয়ে থাকা এক গর্বিত অ্যালামনাই পরিবার, যারা বিশ্বজুড়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উজ্জ্বল করছে।
এই প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের জন্য আমরা স্বপ্ন দেখি একটি মুক্ত চিন্তা, নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধভিত্তিক বিদ্যাচর্চার পরিবেশ— যেখানে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় হবে একটি আলোকিত ভবিষ্যতের ভিত্তি। আমরা আশাবাদী, বর্তমান প্রশাসন সেই লক্ষ্য অর্জনে নিষ্ঠাবান থাকবে এবং আগামী দিনের নেতৃত্ব গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হায়দার আলী বলেন, জ্ঞানবিজ্ঞান ও সময়ের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে একটি প্রথম শ্রেণির বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলতে চাই, যেখানে দক্ষ ও মানবিক মানুষ তৈরি হবে এবং যা বিশ্বমানের চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
আজ যখন ক্যাম্পাসজুড়ে উড়ছে রঙিন পতাকা, বাজছে বরণ-বাজনা, তখন প্রতিটি হৃদয়ে যেন একই গান— এই বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের গর্ব, আমাদের আশ্রয়, আমাদের সম্ভাবনার দিগন্ত। দুই দশকের পথচলার এ দিনটি কেবল উৎসবের নয়, এটি স্মৃতির, শ্রদ্ধার এবং প্রতিজ্ঞার।
চলবে পথচলা— উচ্চতর জ্ঞানের দিকে, মানবিক নেতৃত্বের দিকে, ন্যায়ের পথে, সাহসের পথে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু ২০ বছরের ইতিহাস নয়— এটি একটি চলমান ভবিষ্যতের নাম।
মন্তব্য করুন