আলকামা রমিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশ : ১৮ জুলাই ২০২৫, ১০:৪০ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

‘চোখের নিচের তিলটাই বলে দিত কোনটা মুগ্ধ, কোনটা স্নিগ্ধ’

মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ। ছবি : সংগৃহীত
মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ। ছবি : সংগৃহীত

১৮ জুলাই ২০২৪—বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি রক্তাক্ত বিকেল, একটি নাম—মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ। আজ সেই দিনটির এক বছর। এক বছর হয়ে গেল মুগ্ধ নেই; কিন্তু তার রেখে যাওয়া মুগ্ধতা ছড়িয়ে আছে আন্দোলনের স্লোগানে, একটি পরিবারের প্রতিটি নিঃশ্বাসে।

মুগ্ধর জীবনের শেষ দিনটি ছিল অভ্যাসের মতোই সাধারণ। পরিবারের সবাইকে পৌঁছে দিয়েছিলেন বাসস্টেশনে। পরিবার যাচ্ছিল কক্সবাজার, উখিয়ায়। বিদায়ের সময় মায়ের উদ্দেশে বলে গিয়েছিলেন মাত্র দুটি শব্দ ‘আম্মু, যাই’। সেটাই ছিল তাদের শেষ দেখা। কেউ ভাবেনি, ছেলের মুখ আর দেখা হবে না। পরিবারের সদস্যরা তখনো জানতেন না, যে ছেলে হাসিমুখে বিদায় জানিয়েছিল, সে ওই বিকেলেই ইতিহাস হয়ে যাবে।

বিকেল ৫টা ২২ মিনিটে মুগ্ধ ছিলেন রাজধানী ঢাকার আজমপুরে, যেখানে কোটা সংস্কার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনের অংশ হিসেবে তিনি আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে পানি পান করাচ্ছিলেন। সহযোদ্ধাদের সেবায় ব্যস্ত সে ছেলেটি, ঠিক ২৮ মিনিট পর ৫টা ৫০ মিনিটে গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েন রাজপথে। তার মৃত্যু ছিল আকস্মিক; কিন্তু প্রতিবাদে নিবেদিত ছিল তার প্রতিটি নিঃশ্বাস। মৃত্যুর ৯ মিনিট আগে নিজের মোবাইলে তিনি ধারণ করেছিলেন একটি ভিডিও—সেখানে উপস্থিত সবাইকে গুলির ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন মুগ্ধ। সেটাই ছিল তার শেষ বার্তা।

উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টরের বাড়িটি আজও মুগ্ধর অপেক্ষায় থাকে। তার ঘরের বিছানা, জামাকাপড়, টেবিল সবই আছে আগের মতো। শুধু নেই সেই হাসিমুখের তরুণ।

যমজ ভাই স্নিগ্ধের সঙ্গে ছোটবেলার ছবি দেখিয়ে বাবা এখন বলেন, ‘চোখের নিচের তিলটাই বলে দিত, কোনটা মুগ্ধ, কোনটা স্নিগ্ধ।’ এখন সে চিহ্নই একমাত্র সম্বল।

মৃত্যুর তিন দিন আগে আন্দোলনে যাওয়ার জন্য বাবা-মায়ের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছিলেন মুগ্ধ। বড় ভাই দীপ্তের সঙ্গে ছিল বন্ধুর মতো সম্পর্ক; কিন্তু মুগ্ধর মৃত্যু সংবাদটা শুনতে হয়েছিল উখিয়ায় অবস্থানরত বড় ভাইকেই; মোবাইল ফোনে জানিয়েছিল স্নিগ্ধ।

মায়ের জীবনের প্রথম সমুদ্র দর্শনের সেই দিনে, যখন তিনি অবাক হয়ে ছিলেন প্রকৃতির সৌন্দর্যে, ঠিক তখনই এসে পৌঁছেছিল ছেলের মৃত্যুর খবর। পরিবার চেয়েছিল মুগ্ধকে দাফন করতে উত্তরায় তার দাদা-দাদির কবরের পাশে; কিন্তু নানা জটিলতায় তা সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত তাকে শায়িত করা হয় কামারপাড়া কবরস্থানে, যেখানে কেবল এলাকার ভোটারদের দাফন করার রীতি; কিন্তু মুগ্ধর জন্য সেই নিয়ম ভাঙা হয়।

মুগ্ধ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতক শেষ করে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) থেকে এমবিএ করছিলেন। স্বপ্ন ছিল তার বিমানবাহিনীতে যোগ দেওয়া। সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। টেবিলে তার অর্জিত সব ক্রেস্ট সারি করে সাজানো যেন বলছে, এই তরুণ থেমে যাননি, থামেননি কখনো।

উত্তরার তার বাসার গলিটির নাম এখন ‘মীর মুগ্ধ সড়ক’। সেই গলিতে আর ফিরে আসে না মুগ্ধর পায়ের শব্দ; কিন্তু প্রতিবাদের প্রতিধ্বনির মতো বাজে তার নাম। যে তরুণ অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল বুক চিতিয়ে, সেই নামটি আজ ইতিহাস হয়ে গেছে।

গত ১১ জুলাই বিকেলে কামারপাড়া কবরস্থানে দেখা গেল মুগ্ধর সাদা মার্বেল পাথরের এপিটাফ। তার কবরের বুকে বেড়ে উঠেছে গাঁদা ফুলের গাছ হলুদ ফুলের হাসিতে ছড়িয়ে আছে এক গভীর শান্তি। কবরটি একা নয়, তার পাশে লম্বালম্বি শুয়ে আছেন আরেক শহীদ রিদোয়ান শরীফ রিয়াদ জয়। গাঁদা ফুলের গাছ যেন দুই শহীদের কবরকে এক করে রেখেছে। এ যেন এক পবিত্র যোগসূত্র—মুগ্ধর পথ ধরে জয়; মৃত্যুতে জন্ম নেওয়া এক মহাকাব্য।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

পাকিস্তানের হামলায় ৩ ক্রিকেটার নিহত, সিরিজ খেলবে না আফগানিস্তান

নড়াইলে সাড়ে ১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকবে না

হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরলেন খালেদা জিয়া

মালদ্বীপে হাইকমিশনারের সঙ্গে প্রবাসী নেতাদের সভা অনুষ্ঠিত

জুলাই সনদে সই না করা রাজনীতিকদের প্রতি সালাহউদ্দিন আহমদের বার্তা

পটুয়াখালীতে কালবেলার তৃতীয় বর্ষপূর্তি উদযাপিত

‘ছাত্রশিবিরের বিজয় ইসলাম, মানবতা ও দেশপ্রেমের জয়’

নুরুদ্দিন অপুকে কাছে পেয়ে নেতাকর্মীরা আবেগাপ্লুত

আসছে অদ্ভুুত সব নিয়ম নিয়ে ক্রিকেটের নতুন ফরম্যাট টেস্ট টোয়েন্টি

আফগানিস্তানে আবারও পাকিস্তানের বিমান হামলা

১০

বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দামে ফের রেকর্ড

১১

দূরন্ত গতিতে ছুটছে নারায়ণগঞ্জ গ্ল্যাডিয়েটর্স

১২

সিনিয়রদের পথে হাঁটতে ব্যর্থ প্রীতিরা

১৩

নিজেদের স্বার্থে হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান

১৪

পাবনায় কালবেলার ৩য় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন 

১৫

চরফ্যাশনে কালবেলার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত

১৬

নারায়ণগঞ্জে আবু জাফর আহমদের নির্বাচনী প্রচারণা শুরু

১৭

গাইবান্ধায় কালবেলার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত

১৮

ফেনীতে বর্ণাঢ্য আয়োজনে কালবেলার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত

১৯

রাঙামাটিতে প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে কালবেলার ৩য় বার্ষিকী উদযাপন

২০
X