প্রায় ছয় বছর পর মঙ্গলবার (০৯ সেপ্টেম্বর) অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। এই নির্বাচন নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে চলছে নানা আলোচনা।
নির্বাচনে ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন আলাদা আলাদা প্যানেলে অংশ নিচ্ছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীও হয়েছেন অনেকে।
এ নিয়ে বিভিন্ন জরিপ ফলাফলও প্রকাশ করতে দেখে গেছে কোনো কোনো সংগঠনকে। বিভিন্ন গণমাধ্যমও এটি নিয়ে নানা অনুষ্ঠান প্রচার কিংবা জরিপ চালাতে দেখা গেছে।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেশের রাজনীতিতে হঠাৎ কেন এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল সেই প্রশ্নও সামনে আসছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের শাসনামলে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল। প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন ব্যবস্থায় তরুণদের অনেকেই দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। যে কারণে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর ছাত্র সংসদ নির্বাচন ঘিরে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশের মানুষের মধ্যেও নানা আগ্রহ তৈরি হয়েছে বলেও তারা মনে করেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ছাত্র সংসদ নির্বাচনে হারজিতের ব্যাপারটা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এখন ইজ্জতের লড়াই হয়ে গেছে। যে কারণে এই নির্বাচন ও এর ফলাফল নিয়ে বিএনপি, জামায়াত কিংবা এনসিপির মতো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে উচ্ছ্বাস ও আশঙ্কা দুইটাই আছে।
যে কারণে বিএনপি-এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পেজগুলো থেকে তাদের সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থীদের পক্ষে ভোট চাইতেও দেখা গেছে। এমনকি দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ভোট চাওয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে। এই অভিযোগে ছাত্রদলের একটি উপজেলার সদস্য সচিবকে দল থেকে বহিষ্কারের ঘটনাও ঘটেছে। যদিও বিএনপি বলেছে, তারা এই নির্বাচন ঘিরে দলের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের প্রচারণা চালাননি।
আওয়ামী লীগের সাড়ে পনেরো বছরের শাসনামলে সারাদেশের ক্যাম্পাসগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র একবারই ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৯ সালে। ওই নির্বাচন ঘিরেও ছিল নানা বিতর্ক, নানা প্রশ্ন। পরে আওয়ামী লীগ শাসনামলে ডাকসু কিংবা কোনো ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় নি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যে কারণে অনেক বছর ধরে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীরা ভোটাধিকার চর্চার সুযোগ পাননি। আর সে কারণে গণ-অভ্যুত্থানের পর নতুন পটভূমিতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে অনেক বেশি আগ্রহ তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান বলেন, চব্বিশের আন্দোলন শুরু করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেই আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃত্বের কেউ কেউ এখন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদেও রয়েছেন। যে কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ডাকসু নির্বাচন বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের হামলার পরই গত বছরের জুলাইয়ে সারাদেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ওই আন্দোলনই একপর্যায়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটায়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলছিলেন, বিশেষ করে দুইটি কারণে এবারের ডাকসু নির্বাচন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তার প্রথম কারণ অনেকদিন পরে ভোট অনুষ্ঠিত হচ্ছে, দ্বিতীয়ত জুলাই পটপরিবর্তনের পর দেশের মানুষের মধ্যে আকাঙ্ক্ষা ও চিন্তার দুয়ার খুলে গেছে। যে কারণে এই নির্বাচনকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফেরার একটা অংশ মনে করা হচ্ছে।
এখন থেকে প্রায় চার দশক আগে ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদর রহমান মান্না। তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্দোলনে ডাকসু সব সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। দেশের ক্রান্তিলগ্নেও ডাকসু নেতৃত্ব সংকট থেকে উত্তরণের পথ বাতলে দিয়েছে। যে কারণে ডাকসুর আবেদন ও গুরুত্ব সব সময় ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে।
সর্বশেষ ২০১৯ সালে যে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ওই নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবে ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন বর্তমান গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর। ডাকসুতে ভিপি নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন। একই সঙ্গে জুলাই আন্দোলনে তার দলের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়ার অতীতে বিভিন্ন সময়ে ডাকসুতে যারা ভিপি-জিএস কিংবা গুরুত্বপূর্ণ পদে বিজয়ী হয়েছেন তাদেরও রাজনীতিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখা গেছে। যে কারণে রাজনৈতিক দলগুলোও এবার এই নির্বাচনকে অনেক আলাদা গুরুত্ব দিয়ে দেখছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ডাকসু নির্বাচনকে সারাদেশের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করি, এতে কোন সন্দেহ নেই। এই নির্বাচন কমবেশি জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করবেই।
ডাকসু নির্বাচনের প্রচারণা শুরুর পর থেকেই বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোতে নিয়মিত টকশো, আলোচনা, বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করতে দেখা গেছে। নির্বাচনি প্রচারণা শুরুর পর ছাত্রদল-ছাত্রশিবির-কিংবা প্রগতিশীল সংগঠনগুলোর মধ্যে নানা অভিযোগ পাল্টা অভিযোগও করতে দেখা গেছে।
জামায়াতের ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, জুলাই আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতারাই পাইওনিয়র হিসেবে কাজ করেছে। যে কারণে সফল গণঅভ্যুত্থানের পরও ওই নেতৃত্বের মধ্যে নির্বাচন তো স্বাভাবিকভাবেই দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হবেই।
গত কয়েকদিনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অফিসিয়াল পেজ থেকে তাদের ছাত্র সংগঠনের প্যানেলের প্রার্থীদের পক্ষ থেকে জোর প্রচারণা চালাতেও দেখা গেছে। বিভিন্ন কর্মসূচির লাইভ সম্প্রচার কিংবা ছাত্র সংগঠনের ইশতেহারগুলো প্রচার করতে দেখা গেছে দলীয় অফিসিয়াল পেজ থেকে। ফেসবুকে দলগুলোর অনুসারীরা বিভিন্ন প্রার্থীর পক্ষে ভোট চাইতেও দেখা গেছে।
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, ২০১৯ সালে ডাকসুর শীর্ষ নেতৃত্ব তৈরি হয়েছে কোটা আন্দোলন থেকে। সেই কোটা আন্দোলন থেকেই ২০২৫ সালে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। সুতরাং ডাকসু আগামী দিনের রাজনীতির বড় নিয়ামক সেটা বলাই যায়।
এর বাইরে আরেকটা বিষয়কে বেশ গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন বিশ্লেষকরা। মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, আগামী পাঁচ মাস পর অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনের আগে এবারের ডাকসু নির্বাচন সরকারের জন্য একটা রিহার্সাল। যে কারণে এটার প্রতি সবার নজর।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এবারের ডাকসু নির্বাচন শুধু ক্যাম্পাস রাজনীতির সীমায় আটকে থাকবে না; বরং তা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটারদের মানসিকতা ও রাজনৈতিক সমীকরণেও বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাশেদা রওনক খান বলছিলেন, ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল অনেক বেশি প্রভাব রাখবে জাতীয় রাজনীতিতে। কারণ ধরে নেওয়া হচ্ছে এখানে যারা জয়ী হবে তাদের একটা মনস্তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক প্রভাব তৈরি হবে সারা বাংলাদেশে।
যে কারণে জামায়াত ইসলামীও এই নির্বাচনকে আলাদা গুরুত্ব দিচ্ছে। জামায়াত নেতা এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, অতীতেও ডাকসুতে যারা নির্বাচিত হয়েছে তারা জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই নির্বাচনের ফলাফলের বড় কোন প্রভাব না পড়লেও কমবেশি একটা প্রভাব থাকবে আগামী নির্বাচনে।
ভোটের ফলাফলের লাভ ক্ষতির অঙ্কের বাইরেও একটি বিষয়কে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বিশেষ করে তরুণরাই রাজনীতির বড় নিয়ামক ও রাজনীতি সচেতন।
মহিউদ্দিন আহমদ বলছিলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তরুণদের চিন্তা ভাবনায় সব সময়ের জন্য ক্ষমতার বিপরীতে থাকে। যে কারণে সরকারি দল বা সরকার সমর্থিতরা এসব ভোটে খুব একটা ভাল ফল পায় না। যেহেতু এবার নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ভোট সে কারণে এবারের ভোটটা হবে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যও একটা ইজ্জতের লড়াই।
আর এসব কারণে ছাত্র সংসদের ভোট হলেও বড় রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের ফল ঘরে তুলতে অনেকটা একাট্টা হয়েই মাঠে নেমেছে বলেও ধারণা দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা।
মন্তব্য করুন