কখনো ভেবে দেখেছেন প্রসাব কয় রঙের হয়? অনেকের ধারণা প্রসাব শুধু হলুদ রঙেই হয়ে থাকে। তবে না, প্রস্রাবের রং লাল, হলুদ, গোলাপি কিংবা সবুজ— কখনও আবার রংধনুর মতোও হয়ে থাকে। অবাক করার মত বিষয় হলেও সত্যি বিষয় হলো, প্রস্রাবের রং বেগুনি, কমলা বা নীলও হতে পারে। এমনকি অনেক সময় প্রস্রাবের রং এমনও হতে পারে, যা একেবারেই স্বাভাবিক বা পরিচিত কোনও রঙের সঙ্গে মেলে না।
কী অবাক হচ্ছেন? আবাক করার বিষয় হলেও সত্য। আর প্রস্রাবের এই রঙই বলে দেয় শরীরে কী রং বেঁধেছে। সম্প্রতি বিবিসি বাংলার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ওঠে আসে এ তথ্য।
প্রস্রাব হলো শরীরের বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশনের প্রক্রিয়া। সহজভাবে বললে, এর মাধ্যমে শরীর নিজের ভেতরের ময়লা-আবর্জনা বাইরে ফেলে দেয়। প্রোটিন, লোহিত রক্তকণিকা ও মাংসপেশি ভেঙে যে নাইট্রোজেনজাত বর্জ্য তৈরি হয়, তার মূল উপাদান হলো ইউরিয়া ও ক্রিয়েটিনিন।
তবে চলুন প্রস্রাবের রং সঙ্গে কোন রোগের সম্পর্ক তা জেনে নেওয়া যাক-
লাল
যদি কারও প্রস্রাব লাল দেখায়, এটি সাধারণত মানে হলেও এতে রক্ত মিশে আছে। মূত্রনালির যেকোনো সমস্যা লাল রঙের প্রস্রাবের জন্য দায়ী। বিশেষ করে কিডনি, মূত্রাশয়, প্রোস্টেট কিংবা মূত্রনালি সংযুক্ত টিউব থেকে রক্তপাত হলে প্রস্রাব লাল হয়ে যায়।
প্রস্রাবে রক্তের পরিমাণ ও সতেজতার ওপর নির্ভর করে এর রং পরিবর্তিত হয়। কখনও হালকা, আবার প্রবল রক্তপাতের ক্ষেত্রে রং এতটাই গাঢ় হয় যে তা রেড ওয়াইনের মতো দেখাতে পারে।
এ ধরনের রক্তপাতের পেছনে নানা কারণ থাকতে পারে— কিডনিতে পাথর, ক্যান্সার, আঘাত বা মূত্রনালির সংক্রমণ। এমনকি বেশি পরিমাণে বিটরুট খাওয়ার ফলেও প্রস্রাব লালচে হয়ে যেতে পারে।
কমলা ও হলুদ
আমাদের সবারই জানা, স্বাভাবিক অবস্থায় প্রস্রাবের রং সাধারণত হলুদ হয়। তবে এই হলুদের ঘনত্ব নির্ভর করে প্রতিদিন আপনি কতটা পানি পান করছেন তার ওপর। শরীরে পানির ঘাটতি হলে প্রস্রাব গাঢ় হলুদ বা কখনও কমলা রঙের হতে পারে। আর পর্যাপ্ত পানি পান করলে প্রস্রাব হবে হালকা ও ফ্যাকাশে হলুদ।
প্রস্রাবের হলুদ রঙের জন্য দায়ী উপাদান হলো ইউরোবিলিন। শরীরে পুরোনো লোহিত রক্তকণিকা ভেঙে ইউরোবিলিন তৈরি হয় এবং এগুলো প্রস্রাবের মাধ্যমে বেরিয়ে যায়। এ প্রক্রিয়ায় শরীরে তৈরি হয় আরেকটি যৌগ— বিলিরুবিন। এর কিছু অংশ প্রস্রাব দিয়ে বের হয়, আর কিছু লিভারে পিত্তরস তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
পিত্তরস হজমে সহায়তা করে এবং চর্বি ভেঙে দেয়। এটি অন্ত্রে থেকে মলের সঙ্গে বেরিয়ে আসে, আর এর কারণেই মলের রং বাদামি হয়। কিন্তু যদি পিত্তথলিতে পাথর বা ক্যানসারের কারণে পিত্তনালি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে পিত্ত অন্ত্রে পৌঁছায় না। তখন বিলিরুবিন রক্তে ফিরে গিয়ে প্রস্রাবের মাধ্যমে বের হতে শুরু করে। এর ফলে প্রস্রাবের রং গাঢ় হয়ে যায়— কমলা বা বাদামি।
প্রস্রাবে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে গেলে ত্বকের রংও হলুদ হয়ে যায়, যাকে বলা হয় অবস্ট্রাকটিভ জন্ডিস। তবে কিছু ওষুধও প্রস্রাবকে কমলা রঙা করে দিতে পারে।
সবুজ ও নীল
সবুজ বা নীল রঙের প্রস্রাব হওয়া অত্যন্ত বিরল ঘটনা। প্রস্রাব করার পর যদি এমন রং দেখা যায়, তা অবশ্যই অবাক করার মতো বিষয়।
টয়লেটে বাইরের কোনও উপাদান রং না বদলালে, শরীরের ভেতরের কিছু কারণে প্রস্রাব সবুজ বা নীল হতে পারে। যেমন— খাবারে কৃত্রিম সবুজ বা নীল রং ব্যবহার করা হলে এবং সেগুলো অতিরিক্ত খেলে প্রস্রাবের রং পরিবর্তিত হতে পারে। এ ছাড়া চেতনানাশক, ভিটামিন বা অ্যান্টিহিস্টামিনের মতো কিছু ওষুধও প্রস্রাবকে সবুজ বা নীল করে দিতে পারে।
আরেকটি বিশেষ কারণ হলো ব্যাকটেরিয়া। কিছু ব্যাকটেরিয়া এমন যৌগ তৈরি করে যার রং সবুজ। বিশেষ করে সিউডোমোনাস অ্যারুগিনোসা নামের ব্যাকটেরিয়া পাইওসায়ানিন নামক নীল-সবুজ যৌগ উৎপাদন করে। এটি মূত্রনালির সংক্রমণের একটি বিরল কারণ। এ সংক্রমণে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রস্রাব করার সময় জ্বালাপোড়া ও ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
বেগুনি
বেগুনি বা ইন্ডিগো রঙের প্রস্রাব হওয়াও অত্যন্ত বিরল ঘটনা। এর একটি সম্ভাব্য কারণ হলো পোরফাইরিয়া, এক ধরনের জেনেটিক রোগ যা ত্বক ও স্নায়ুতন্ত্রকে প্রভাবিত করে।
এ ছাড়া আরেকটি বিশেষ কারণ হলো ‘পার্পল ইউরিন ব্যাগ সিনড্রোম’। এটি একটি বিরল অবস্থা, যা সাধারণত মূত্রনালির সংক্রমণের কারণে দেখা দেয়। বিশেষ করে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় যেসব রোগীর প্রস্রাব বের করার জন্য ক্যাথিটার ব্যবহার করা হয়, তাদের ক্যাথিটার ব্যাগে মাঝে মাঝে বেগুনি রঙের দাগ পরতে দেখা যায়।
বেগুনি বা গোলাপি
রক্ত ও বিটরুটের সম্পর্ক আবারও উল্লেখযোগ্য। সামান্য পরিমাণ বিটরুট খেলে প্রস্রাব গাঢ় লাল না হয়ে গোলাপি রঙ ধারণ করতে পারে। এ অবস্থাকে চিকিৎসকেরা প্রায়ই রোজ ওয়াইনের রঙের সঙ্গে তুলনা করেন।
অন্যান্য রং
প্রস্রাবের রং শুধু রংধনুর সাত রঙে সীমাবদ্ধ নয়। কখনও এটি অতিরিক্ত গাঢ় হয়ে বাদামি বা কালো রঙ ধারণ করতে পারে। ডাক্তাররা এমন রঙকে কখনও কোকা-কোলার সঙ্গে তুলনা করেন।
এ ধরনের পরিবর্তন গুরুতর রোগ র্যাবডোমাইলাইসিস-এর লক্ষণ হতে পারে, যা অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম বা কিছু ওষুধের কারণে ঘটতে পারে।
প্রস্রাবের গাঢ় রং বিলিরুবিন-এর মাত্রার কারণে হতে পারে, যা স্বাভাবিক কমলার পরিবর্তে বাদামি রং তৈরি করে। তবে রক্ত উপস্থিত থাকলেও প্রস্রাব এই রং ধারণ করতে পারে।
কিডনির প্রদাহও প্রস্রাবের রং পরিবর্তনের কারণ হতে পারে। কিডনির সমস্যা থাকলে, প্রস্রাব মূত্রনালির মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় লাল থেকে বাদামি রং ধারণ করে।
এখানেই শেষ নয়। রংহীন প্রস্রাবও আছে।
প্রস্রাবের রং গাঢ় হলুদ হওয়া কিন্তু স্বাভাবিক নয়। খুব পাতলা প্রস্রাবও কিছু রোগের সংকেত দিতে পারে, যেমন ডায়াবেটিস বা অতিরিক্ত মদপান।
এই প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পারি যে প্রস্রাব বিভিন্ন রঙ ধারণ করতে পারে এবং প্রতিটি রং কিছু নির্দিষ্ট সমস্যার ইঙ্গিত দিতে পারে। তবে চিকিৎসকদের মতে, এটি কখনো সম্পূর্ণ তালিকা নয়।
যদি আপনার প্রস্রাবের রং অস্বাভাবিক হয় এবং কারণটি বুঝতে চান, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি যথেষ্ট পানি পান করা ও জরুরি।
মন্তব্য করুন