কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আব্দুল মঈনের বিরুদ্ধে গাড়ি ক্রয়ে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদিত অর্থের বেশি খরচ, নির্দেশনা ভঙ্গ করে প্রায় সাড়ে ৬ বছরের মাথায় নতুন গাড়ি ক্রয়, সরকারের অকেজো ঘোষণাকরণ নীতিমালা অমান্যসহ একাধিক অভিযোগ উঠেছে উপাচার্যের বিরুদ্ধে।
জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে উপাচার্য এবং উপউপাচার্যের জন্য নতুন গাড়ি ক্রয়ের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু উপউপাচার্যের জন্য গাড়ি ক্রয় করা হয়নি। এমনকি পুরাতন গাড়িটি অকেজো ঘোষণা কিংবা নতুন গাড়ির বরাদ্দ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে মঞ্জুরি কমিশনের কোনো অনুমোদন নেননি উপাচার্য।
জানা যায়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপউপাচার্যের জন্য নিয়োগের পর কোনো গাড়ি ক্রয় করা হয়নি। বর্তমানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প পরিচালকের একটি গাড়ি ব্যবহার করেন। যেটির মডেল মিতসুবিসি আউটলেন্ডার।
গাড়ি ক্রয়ের বিষয়ে কথা বলতে চাইলে উপউপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হুমায়ুন কবির বলেন, উপাচার্য এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমি মন্তব্য করতে চাই না।
জানা যায়, গত ৭ জুন মঞ্জুরি কমিশনের সচিব বরাবর দুটি মিতসুবিসি পাজেরো স্পোর্টস ছঢ/ সমমান জিপ নতুন ভার্সনের গাড়ি ক্রয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার স্বাক্ষরিত পত্রে অনুমোদনের জন্য আবেদন করা হয়। আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ১৩ জুন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে সংশ্লিষ্ট খাতে বরাদ্দ হতে কয়েকটি শর্তসাপেক্ষে উপাচার্য এবং উপউপাচার্যের দাপ্তরিক কাজে ব্যবহারের জন্য দুটি জিপ গাড়ি ক্রয়ের অনুমোদন দেয়।
তবে দুটি গাড়ির অনুমোদনের জন্য আবেদন করা হলেও প্রকৃতপক্ষে শুধু উপাচার্যের জন্য বরাদ্দের চেয়ে বেশি অর্থ খরচ করে একটি গাড়ি ক্রয় করা হয়। যদিও চলতি বছরেই উপাচার্যের পুরাতন গাড়িটির মেরামতে প্রায় ৫ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়। ফলে উপাচার্য একইসাথে নতুন এবং পুরাতন দুটি গাড়িই ব্যবহার করছেন।
যদিও গাড়ি ক্রয়ে কমিশনের অনুমোদনের শর্তগুলো ছিল বরাদ্দকৃত অর্থের বেশি ব্যয় করা যাবে না, সরকারি ক্রয় নীতিমালা অনুসরণ করে গাড়ি ক্রয় করতে হবে, সরকারের অকেজো ঘোষণাকরণ নীতিমালা অনুসরণ করে পুরাতন গাড়িটি (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) অকেজো ঘোষণা করতে হবে এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ক্রয়কৃত গাড়ি যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্গানোগ্রামে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
তবে নতুন গাড়ি ক্রয়ের ক্ষেত্রে ইউজিসির অনুমোদনপত্রে সরকারের অকেজো ঘোষণাকরণ নীতিমালা অনুসরণ করে পুরাতন গাড়িটি (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) অকেজো ঘোষণা করার কথা বলা হলেও মানা হয়নি সেই নির্দেশনাও। বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এদিকে মঞ্জুরি কমিশনের অর্থ ও হিসাব বিভাগের পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. রেজাউল করিম হাওলাদার জানান, উপাচার্য গাড়ি কিনেছেন এ বিষয়টি আমরা জানি না। আমাদের নথিতে নেই। আমার জানামতে গাড়ি ক্রয়ে বর্তমানে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। নিষেধাজ্ঞার ফলে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে গাড়ির সংকট রয়েছে। বিষয়টি আমার জানা নেই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়কে সেবা দেই। উপাচার্য আমাদের নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি যেভাবে বলবেন আমাদের সেভাবেই কাজ করতে হবে। গাড়ি ক্রয়ের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারব না।
বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, উপাচার্য কৃচ্ছ্রসাধনের কথা বলে বৃহস্পতিবারে শিক্ষার্থীদের বাস বন্ধ করে দিয়েছেন। অথচ নিজে দুটি গাড়ি ব্যবহার করছেন। গাড়ি ক্রয়ের নির্দেশনা হচ্ছে সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে পুরাতন গাড়ি অকেজো ঘোষণা করে নতুন গাড়ি ক্রয় করবেন। সেটিও অমান্য করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যই যদি তিনি নিয়মের ব্যত্যয় করেন, তাহলে অন্য যারা আছেন তাদের অবস্থাটা কী হবে! বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আমি প্রত্যাশা করি উপাচার্য সব বিষয়ে সরকারি ও ইউজিসির নির্দেশনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেনে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করবেন।
এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে মঞ্জুরি কমিশনের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ জামিনুর রহমান জানান, পুরাতন গাড়ি অকেজো ঘোষণা করেই নতুন গাড়ি কিনতে হবে। একইভাবে ৯৪ লাখ টাকা বরাদ্দ হলে এর ভেতরেই গাড়ি ক্রয় করতে হবে। বেশি খরচ করা যাবে না। এক্ষেত্রে আমরা অনুমোদন পত্রে শর্তগুলো উল্লেখ করেছি। শর্ত না মানা হলে পরে অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমরা ব্যবস্থা নেব।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর জানান, গাড়ি ব্যবহারের অনুপযোগী হলে সেক্ষেত্রে অকেজো ঘোষণা করে নতুন গাড়ি ক্রয় করতে হয়। এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। সেটি অনুসরণ করতে হয়। আর কেউ যদি বরাদ্দের বেশি অর্থ খরচ করেন তাহলে সেটি অডিট আপত্তিতে পড়ে যাবে।
জানা যায়, দুটি গাড়ি ক্রয়ে বরাদ্দ ১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ও হিসাব দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী শুধু উপাচার্যের গাড়ি ক্রয়ে ব্যয় করা হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৪৬ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। পুরাতন গাড়ির মেয়াদের প্রায় ৬ বছর ৮ মাসের মাথায় নতুন গাড়িটি কেনা হয়। যদিও অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক পরিপত্রে ১০ বছরের অধিক পুরোনো মোটরযান প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের অনুমোদনক্রমে ব্যয় নির্বাহ করার কথা জানানো হয়। এক্ষেত্রেও প্রশাসন নির্দেশনা ভঙ্গ করেছেন।
তবে এসব অনিয়মের বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আব্দুল মঈনের বক্তব্যের জন্য তার কার্যালয়ে গেলে তিনি ব্যস্ততার কথা বলে দেখা করেননি। পরে মোবাইলে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি কল রিসিভ করেননি এবং ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলেও তার কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
মন্তব্য করুন