রাজধানী ঢাকার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিভাগীয় শহরগুলোতেও বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা। অন্যান্য বিভাগের মতো বরিশালেও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। প্রতিদিনই বিভাগের হাসপাতালগুলোতে গড়ে দুই থেকে তিনশ রোগী ভর্তি হচ্ছে। এর ফলে গত তিন মাসেই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ছয় হাজার ছাড়িয়েছে। মৃত্যুবরণ করেছেন ১১ জন।
এদিকে, রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় সরকারি হাসপাতালগুলোতে ফুরিয়ে আসতে শুরু করেছে ডেঙ্গুজ্বর পরীক্ষার ডিভাইস (কিট)। বর্তমানে যা মজুত আছে তা দিয়ে কোনো কোনো জেলায় সর্বোচ্চ ১৫ দিন পর্যন্ত পরীক্ষা করা যাবে। আবার কোনো কোনো জেলায় মজুত কিট দিয়ে এক সপ্তাহ চলবে কি না তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
তবে কিট সরবরাহের বিষয়ে এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ে দফায় দফায় চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন জেলার সিভিল সার্জনরা। তা ছাড়া আগামী সপ্তাহেই নতুন করে কিট সরবরাহের কার্যক্রম চালু হবে বলে জানিয়েছেন বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল এবং বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. এইচ এম সাইফুল ইসলাম। তাই এ নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই বলে জানিয়েছেন তারা।
স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের শুরু থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত বরিশাল বিভাগের ছয় জেলার দুটি মেডিকেল কলেজ এবং ৬টি জেলা সদর হাসপাতালসহ অন্যান্য উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে মোট ৬ হাজার ১৬৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছে। বর্তমানে হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাধীন আছেন ৯০২ জন ডেঙ্গু রোগী।
অপরদিকে, বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে আটজন। আর এখন পর্যন্ত চিকিৎসা নিয়েছেন এক হাজার ৭১৮ জন। হাসপাতালটিতে বর্তমানে ভর্তি আছেন ২৩৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী।
সর্বশেষ বুধবার সকাল ৮টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নতুন করে ৭২ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। আর বিভাগজুড়ে এর সংখ্যা ২৯৬ জন।
এর মধ্যে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বরিশাল জেলায় ১১৭ জন, পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজসহ এ জেলার হাসপাতালগুলোতে নতুন ভর্তি হয়েছে ৬১ জন। এ ছাড়া ভোলা জেলায় ৩৬ জন, পিরোজপুরে ৪৫ জন, বরগুনায় ২৯ জন এবং ঝালকাঠি জেলার হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন সর্বনিম্ন আটজন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বৃদ্ধি পাওয়ায় বরিশাল বিভাগের হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগের পরীক্ষাও বেড়েছে কয়েকগুণ। জ্বর নিয়ে আসা রোগীদের বাধ্যতামূলকভাবে ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে হচ্ছে। তবে প্রতিদিন কী পরিমাণ রোগীর ডেঙ্গু পরীক্ষা করা হচ্ছে তার সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান স্বাস্থ্য বিভাগে না থাকলেও এর সংখ্যা দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার ছাড়াবে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। আর গণহারে ডেঙ্গু পরীক্ষা করায় হাসপাতালগুলোতে ফুরিয়ে আসতে শুরু করেছে পরীক্ষার ডিভাইস বা কিট।
দক্ষিণবঙ্গের সর্ববৃহৎ চিকিৎসা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্যাথালজি বিভাগের ইনচার্জ জ্যেষ্ঠ টেকনিশিয়ান মজিবর রহমান কালবেলাকে জানান, ‘তাদের ল্যাবে প্রতিদিন একশতোর বেশি রোগীর ডেঙ্গু পরীক্ষা করা হচ্ছে। তবে সর্বোচ্চ ৩-৫ পাঁচজনের ডেঙ্গু পজিটিভ পাওয়া যাচ্ছে। গণহারে পরীক্ষা করায় কিট বেশি লাগছে। তবে এখন পর্যন্ত আমরা কিট সংকটে পরিনি।’
বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. এইচ এম সাইফুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, যেসব রোগী ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে হাসপাতালে আসছে তাদের সবার আগে ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে দেওয়া হচ্ছে। গণহারে পরীক্ষা করার কারণে মজুত থাকা কিটের সংখ্যা কমে আসছে। বর্তমানে আমাদের কাছে যে পরিমাণ কিট মজুত আছে তা দিয়ে সর্বোচ্চ ১৫ দিন যাবে। তবে তার আগেই আগামী শনিবার অথবা রোববারের মধ্যে কিট সরবরাহ করা হবে।
অপরদিকে, ‘বিভাগীয় শহর বরিশাল নগরীর বাইরে অন্য জেলাগুলোতে ডেঙ্গু পরীক্ষার কিটের মজুত আরও কমেছে। জেলাগুলোতে যে কিট মজুত আছে তা দিয়ে সর্বোচ্চ এক সপ্তাহ পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছেন স্ব স্ব জেলার সিভিল সার্জনরা।
ডেঙ্গু প্রবণ দীপজেলা ভোলার সিভিল সার্জন ডা. এ কে এম শফিকুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, ‘শুধু ভোলা জেলাতেই নয়, আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি বাংলাদেশের সকল জেলাতেই ডেঙ্গু পরীক্ষার কিট ফুরিয়ে আসছে। আমাদের জেলা নদীমাত্রিক হওয়ায় এখানে প্রতিদিন ৩০-৪০ জনের বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হচ্ছে। বর্তমানে যা কিট মজিত আছে তা দিয়ে আরও অন্তত ৮-১০ দিন চলবে।
অপরদিকে, ‘বরিশালের সিভিল সার্জন ডা. মারিয়া হাসান কালবেলাকে বলেন, যা কিট মজুত আছে তা দিয়ে এখনও এক থেকে দেড় সপ্তাহ পর্যন্ত পরীক্ষা করা যাবে। এ কিটগুলো গত অর্থ বছরে দরপত্রের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। এখন নতুন করে কিট সরবরাহের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হবে। এজন্য মন্ত্রণালয়ে অনুমতি চাওয়া হয়েছে। তবে তার আগে কিট সরবরাহের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চিঠি লেখা হয়েছে।
বরগুনা জেলার সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ফজলুল হক কালবেলাকে জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত বরগুনা জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি। যে কারণে এখানে পরীক্ষাও করা হয় বেশি। বর্তমানে যে কিট মজুত আছে তা দিয়ে সপ্তাহখানেক যাবে। তবে আমরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চাহিদাপত্র পাঠিয়েছি। আশা করছি দুই-একদিনের মধ্যেই কিট পেয়ে যাব।
পিরোজপুর জেলার সিভিল সার্জন ডা. মো. হাসনাত ইউসুফ জাকী কালবেলাকে বলেন, পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি (নেছারাবাদ) উপজেলাতেই ডেঙ্গু আক্রান্তের হার সর্বোচ্চ। এই উপজেলার বলদিয়া ইউনিয়নে প্রতিদিন ২০-২৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হচ্ছে হাসপাতালে। এই ইউনিয়নটিতে প্রচুর নার্সারি রয়েছে। যে কারণে এখানে এডিস মশার বংশবিস্তারও বেশি হচ্ছে।
তিনি বলেন, কেন্দ্রীয়ভাবেই কিটের সংকটের কথা শুনেছি। তবে কিটের হিসাব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে থাকে। মজুতের তথ্য তারাই সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারবে। আমার জানামতে এখন পর্যন্ত যে কিট মজুত আছে তা দিয়ে সর্বোচ্চ ৭ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত যেতে পারে। তবে এটা রোগীর ওপর নির্ভর করে। রোগী বেড়ে গেলে হয়তো আরও আগেই শেষ হবে।
এ ছাড়া পটুয়াখালী জেলার সিভিল সার্জন ডা. এস এম কবির হোসেন কালবেলাকে বলেন, রোগীর চাপ বাড়ায় মজুতকৃত কিটের সংখ্যাও কমে আসছে। আমাদের যা মজুত আছে তা দিয়ে সর্বোচ্চ এক সপ্তাহ যেতে পারে। আমরা সিভিল সার্জন অফিসে এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো থেকেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কিট চেয়ে চাহিদাপত্র পাঠিয়েছি। মূলত তারাই আমাদের কিট সরবরাহ করে থাকে। আশা করছি ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই কিট পেয়ে যাব।
যদিও ডেঙ্গু পরীক্ষার কিট ফুরিয়ে আসার তথ্য সঠিক নয় বলে দাবি করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল।
কালবেলাকে তিনি বলেন, স্থানীয়ভাবে টেন্ডার করে এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রতিনিয়ত কিট সরবরাহ করা হচ্ছে। নতুন করে কিট সরবরাহের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তাছাড়া ৭-১৫ দিন অনেক সময়। এর মধ্যেই ডেঙ্গু পরীক্ষার কিট পেয়ে যাব। তাই কিট সংকট নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই।
মন্তব্য করুন