শুধু পেট নয়, মনও ভরে যায় খেতে বসে একটা ভালো ভর্তা পেলে। রান্নাঘরের এক কোনায় রাখা সেই পুরোনো হামানদিস্তা বা পাটায় বাটা চিংড়ি, চালকুমড়োর খোসা কিংবা ধনেপাতার গন্ধ আজও আমাদের অনেককেই নিয়ে যায় গ্রামের বাড়ির সেই দুপুরবেলায়—যেখানে ভাত মেখে খাওয়ার সময়টা ছিল একেকটা ছোট উৎসবের মতো।
আজকের লেখায় থাকছে এমনই কিছু ভর্তা আর বাটার রেসিপি, যেগুলো একদিকে যেমন সহজ, অন্যদিকে তেমনই পরিপূর্ণ। চাইলে রোজকার মেনুতে এই মজার স্বাদের ছোঁয়ায় আনতে পারেন একটু নস্টালজিয়া, একটু শান্তি।
কচি লাউপাতা, রসুন, কাঁচা টমেটো, কাঁচা মরিচ আর ধনেপাতার মিশেলে তৈরি এই বাটা সরষের তেলে ভাজা হলে তার গন্ধেই পেট চোঁচোঁ করে ওঠে। গরম ভাত, একটু লেবুর রস আর এই বাটা—একমাত্র শান্তির খাবার বলতে যা বোঝায়।
রেসিপি
টাটকা, কচি লাউ পাতা পরিষ্কার করে ধুয়ে নিতে হবে। বেশ খানিকটা পানি গরম করে পাতাগুলো দুই মিনিট হাই ফ্লেমে ভাপিয়ে নিতে হবে। এবারে মিক্সিতে পানি ঝরানো সেদ্ধ করা পাতা, ৮-১০ কোয়া রসুন, একটা মিডিয়াম সাইজের কাঁচা টমেটো, ৪-৫ টা কাঁচা মরিচ, বেশ খানিকটা ধনেপাতা দিয়ে পেস্ট বানিয়ে নিতে হবে।
একটু বেশি করে সরষের তেল গরম করে পেস্ট, লবণ আর মরিচ দিয়ে শুকনো করে নেড়েচেড়ে নিলেই রেডি। একটু লেবুর রস আর এই বাটা দিয়ে গরম ভাত, উফফফ...।
কচি লাউ, টমেটো, রসুন আর পেঁয়াজ দিয়ে তৈরি এই ভর্তায় ধনেপাতার ডাঁটির টুইস্ট আলাদা স্বাদ এনে দেয়। ভাতের সঙ্গে খেতে খেতেই মনে হয়, এমন সহজ কিছুই হয়তো সবচেয়ে উপাদেয়।
রেসিপি
কচি লাউ ছোটো ডুমু করে কেটে নিতে হবে। কড়াইয়ে ১ টেবিল চামচ সরষের তেল দিয়ে একমুঠো পেঁয়াজ, আট-দশ কোয়া রসুন বেশ ভালো করে লাল করে ভেজে নিতে হবে। তারপর লাউ, টমেটো, কাঁচামরিচ, লবণ দিয়ে মিডিয়াম টু হাই আঁচে ৩-৪ মিনিট নাড়াচাড়া করে নিয়ে বেশ খানিকটা ধনেপাতার ডাঁটি অংশটা দিয়ে গ্যাসের আঁচ লো করে ঢাকা চাপা দিয়ে লাউ নরম হয়ে যাওয়া পর্যন্ত একটু রান্না করে নিতে হবে। তারপর লাউ নরম হলে নামিয়ে একটু ঠান্ডা করে নিতে হবে। এবারে মিক্সিতে লাউ দিয়ে পানি ছাড়া একটা পেস্ট বানিয়ে নিতে হবে।
২ চামচ তেল গরম করে পেস্ট টাকে একদম শুকনো হয়ে আসা পর্যন্ত রান্না করে নিলেই রেডি। গরম ভাতে কাঁচা সরষের তেল, একটু লেবুর রস আর এই ভর্তা মেখে খেতে কিন্তু অসাধারণ লাগে।
চিংড়ি আর পটোলের জুটি এমনিতেই দুর্দান্ত। এই ভর্তায় কাঁচামরিচ, রসুন আর পেঁয়াজ দিয়ে তৈরি মসলার ভাজা যখন পেস্ট হয়ে যায়, তখন তার গন্ধেই খিদে বেড়ে যায় দ্বিগুণ।
রেসিপি
একমুঠো চিংড়ি মাছ লবণ, হলুদ মাখিয়ে সরষের তেলে ভেজে তুলে রাখতে হবে।
এবারে বাকি তেলে ৪-৫ কোয়া রসুন কুচি, ১টা পেঁয়াজ কুচি, ৫টা পটোল কুচি, ২-৪টা কাঁচামরিচ, লবণ, হলুদ দিয়ে মিডিয়াম আছে বেশ ভালো করে ভেজে নিতে হবে।
মিডিয়াম আঁচে তিন চার মিনিট নেড়ে ভাজাটাকে একটু ঠান্ডা করে নিতে হবে। মিক্সিতে চিংড়ি মাছ ভাজা, পটোল ভাজা একসঙ্গে দিয়ে পেস্ট বানিয়ে নিতে হবে পানি ছাড়া। এবারে গরম সরষের তেলে পটোল চিংড়ি বাটা দিয়ে একদম শুকনো করে নেড়ে নিলেই রেডি।
চিকেন, পুড়ে নেওয়া টমেটো, রসুন আর পেঁয়াজের কুঁচি একসঙ্গে ভেজে তৈরি হয় এক জম্পেশ ভর্তা। ধনেপাতা কুচি দিয়ে গরম ভাতে মেখে খেলে একেবারে রেস্টুরেন্টের স্বাদ।
রেসিপি
১টা টমেটো, রসুন, পেঁয়াজ, কাঁচা লঙ্কা গ্যাসে একটু পুড়িয়ে নিতে হবে তারজালির ওপর রেখে। তারপর ঠান্ডা হলে খোসা ছাড়িয়ে মিহি করে কুচিয়ে নিতে হবে।
বোনলেস চিকেন পানিতে ১০ মিনিট সেদ্ধ করে নিতে হবে। ঠান্ডা হলে চিকেন কিমা করে নিতে হবে।
এবারে কড়াইয়ে ২ টেবিল চামচ সরষের তেল গরম করে কুচানো পেঁয়াজ, টমেটো সব কিছু একসঙ্গে দিয়ে ভালো করে ভাজা করে চিকেন, লবণ দিয়ে আরো দু-তিন মিনিট নেড়েচেড়ে বেশ খানিকটা ধনেপাতা কুচি মিশিয়ে নামিয়ে নিলেই রেডি।
গরম ভাতের সঙ্গে লেবুর রস, কাঁচামরিচ দিয়ে মেখে খেলে জাস্ট অসাধারণ।
ঝিঙের মতো সাধারণ সবজিও যখন ভর্তা হয়ে আসে পাতে, তখন বোঝা যায়—রান্না আসলে কতটা শিল্প। রসুন, কাঁচামরিচ আর ধনেপাতা মিশে গেলে এই ভর্তার গন্ধেই মন ভালো হয়ে যায়।
রেসিপি
দুটো মিডিয়াম সাইজের ঝিঙে খোসা ছাড়িয়ে ছোট টুকরো করে কেটে নিতে হবে। ১ টেবিল চামচ সরষের তেল গরম করে পেঁয়াজ কুচি, ৮-১০ কোয়া রসুন, ৩-৪টা কাঁচামরিচ, লবণ, ঝিঙে দিয়ে ভালো করে ভেজে নিতে হবে। এবারে ঝিঙে ভাজা হলে বেশ খানিকটা ধনেপাতা দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে নামিয়ে ঠান্ডা করে নিতে হবে।
ঠান্ডা হলে মিক্সিতে পানি ছাড়া পেস্ট বানিয়ে নিতে হবে। দুই টেবিল চামচ সরষের তেল গরম করে ঝিঙের পেস্ট দিয়ে একদম শুকনো করে নেড়ে নিলেই রেডি।
গরম ভাতে লেবুর রস আর ভর্তা, মানে বলতেই খিদে পেয়ে গেল।
মসুর ডাল আর চিংড়ির বাটায় টুকটুক করে থাকা কাঁচামরিচের ঝাঁজ আর একটু চিনি—এই মিষ্টি ঝাল স্বাদের মেলবন্ধনেই তৈরি হয় এক নতুন অভিজ্ঞতা।
রেসিপি
হাফ কাপ মসুরির ডাল ভালো করে ধুয়ে নিয়ে এক কাপ পানি (যে কাপ মেপে ডাল তার দুকাপ পানি) চেরা কাঁচামরিচ দিয়ে ভালো করে সেদ্ধ করে নিতে হবে। একদম শুকনোভাবেই এটা সেদ্ধ হবে। কোনোরকম পানি থাকবে না তো শেষে একটা টমেটো কুচি দিয়ে খুব ভালো করে মিশিয়ে নিয়ে আরও দু-তিন মিনিট রান্না করে নিতে হবে।
এক মুঠো চিংড়ি ভালো করে ধুয়ে নিয়ে লবণ, হলুদ মাখিয়ে রাখতে হবে। সর্ষের তেলে ১টা পেঁয়াজ, ৮-১০ কোয়া রসুন আর কাঁচামরিচ ভালো করে ভেজে নিতে হবে। তারপর চিংড়ি, লবণ, হলুদ দিয়ে দু-মিনিট নাড়াচাড়া করে নামিয়ে মিশ্রণটাকে ঠান্ডা করে নিতে হবে। এবারে মিক্সিতে সেদ্ধ ডাল, চিংড়ি ভাজা দিয়ে একটা পেস্ট বানিয়ে নিতে হবে।
বেশ খানিকটা সরষের তেল গরম করে পেস্টটা, দু-এক দানা চিনি বেশ খানিকটা কাঁচামরিচ কুচি দিয়ে একদম শুকনো করে নাড়াচাড়া করে নিলেই রেডি।
ধনেপাতা, পোস্ত আর কাঁচামরিচ দিয়ে তৈরি এই নিরামিষ বাটা, টমেটোর টক টক ভাবে হয়ে ওঠে ভাতের সঙ্গে এক অসাধারণ সঙ্গী। মাংস-চিংড়ি ছাড়াও যে ভর্তা হতে পারে তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।
রেসিপি
টাটকা ধনেপাতা পরিষ্কার করে ধুয়ে নিতে হবে। পাতা ও ডাঁটা সমেত ব্যবহার হবে শুধুমাত্র বাদ যাবে গোড়া। মিক্সিতে এক চামচ পোস্তদানা (একদম এর বেশি না), ধনেপাতা এক আঁটি, চারটে কাঁচামরিচ, ছোটো টমেটো দেড়টা দিয়ে মিহি পেস্ট বানিয়ে নিতে হবে। এবারে বেশ খানিকটা সরষের তেলে পেস্ট আর লবণ দিয়ে একদম শুকনো করে নেড়ে নিলেই রেডি। গরম ভাত ও এই বাটা খাওয়া কমপ্লিট।
শুধু ভাজা চিংড়ি আর কাঁচামরিচ দিয়ে বানানো এই সহজ বাটায় সরষের তেলের খেলা এমন এক স্বাদ আনে, যার কাছে কোনো ঝাল মাংসও হার মানে।
রেসিপি
চিংড়ি মাছ ভালো করে ধুয়ে লবণ, হলুদ মাখিয়ে ভেজে নিতে হবে। এবারে কাঁচামরিচ, সরষের তেল দিয়ে চিংড়ি মাছ বেটে (মিক্সিতে বা শিলে, শিলেই বেশি টেস্ট, আমি হামান দিস্তায় দুবারে রেডি করেছি) নিতে হবে। এবারে একটা পেঁয়াজ মিহি করে কুচিয়ে আর একটু সরষের তেল দিয়ে ভালো করে মেখে নিলেই রেডি।
ফেলে দেওয়া চালকুমড়োর খোসা দিয়েই তৈরি হতে পারে এক দুর্দান্ত খাবার! রসুন, কাঁচামরিচ আর শুকনো লঙ্কার ফোড়নে তৈরি এই ভর্তা খেতে যেমন স্বাদে ভরপুর, তেমনই পুষ্টিকর।
রেসিপি
কচি চাল কুমড়োর খোসা একটু মোটা করে কেটে দুই থেকে তিনবার ভালো করে জল পাল্টে ধুয়ে নিতে হবে। ছোটো করে কেটে গরম জলে তিন থেকে চার মিনিট সেদ্ধ করে নিতে হবে।
এবারে মিক্সিতে পানি ঝরানো সেদ্ধ করা খোসা, রসুন কোয়া ৭-৮ টা, কাঁচামরিচ ৩-৪টা দিয়ে ভালো করে পেস্ট বানিয়ে নিতে হবে।
গরম সরষের তেলে শুকনো মরিচ ফোড়ন দিয়ে খোসা বাটা, লবণ দিয়ে একদম পানি শুকিয়ে শুকনো করে নেড়ে নিতে হবে।
শেষে লেবুর রস মিশিয়ে নেড়েচেড়ে নিলেই রেডি।
পটোলের খোসা, রসুন আর একটু কালোজিরে—এই কম্বিনেশনেই তৈরি হয় এক অন্যরকম স্বাদ। কেউ খেয়ে বলবে, এটা পটল? এতটা ভালো?
রেসিপি
৬টা পটোল ভালো করে ধুয়ে মোটা করে খোসা ছাড়িয়ে নিতে হবে। খানিকটা পানি গরম করে ৩-৪ মিনিট সেদ্ধ করে নিতে হবে।
এবারে মিক্সিতে খোসা, ১০-১২ কোয়া রসুন, ৪ টে কাঁচা মরিচ, ১ চামচ কালো জিরে, অল্প ধনেপাতা দিয়ে পানি ছাড়া একটা পেস্ট বানিয়ে নিতে হবে। কড়াইয়ে ২ টেবিল চামচ সরষের তেল দিয়ে পেস্ট, লবণ দিয়ে একদম শুকনো করে নেড়ে নিলেই রেডি।
সবজির মধ্যেও যে চিংড়ি নিজের জায়গা ঠিক বানিয়ে নিতে জানে, তার প্রমাণ এই রেসিপি। গরম ভাতে মেখে নিলেই আর কিছু লাগে না—শুধু একটু সময়, আর খাওয়ার সঙ্গী।
রেসিপি
বিনস্ কেটে ৪ মিনিট পানিতে সেদ্ধ করে নিতে হবে। এবারে এক চামচ সরষের তেলে রসুন কুচি ৭-৮ টা, পেঁয়াজ একটা, ৫-৬ টা কাঁচা মরিচ (ঝাল ঝাল বেশি ভালো লাগে) চিংড়ি এক মুঠো, সেদ্ধ বিনস্, লবণ, হলুদ দিয়ে তিন মিনিট নেড়েচেড়ে ঠান্ডা করে মিক্সিতে পেস্ট করে নিতে হবে।
এবারে একটু বেশি করে সরষের তেল গরম করে পেস্ট দিয়ে একদম শুকনো করে নামিয়ে নিলেই রেডি। শুকনো লঙ্কা ফোড়নে দিয়েছি, শুধু গন্ধের জন্য। গরম ভাতে এই ভর্তা আর লেবুর রস মেখে এক গাল মুখে দিলে উফফফ...।
আজকের ব্যস্ত জীবনে যখন রান্না মানেই হয়ে দাঁড়িয়েছে রেডিমেড কিছু গরম করে নেওয়া, তখন এই ভর্তাগুলো আমাদের আবার মনে করিয়ে দেয়—রান্না এক ধরনের ধ্যান। এটা শুধু খাওয়ার জন্য নয়, সময় কাটানোর, আবেগ শেয়ার করার আর বাড়ির সবাইকে এক টেবিলে আনার সবচেয়ে সহজ উপায়।
রেসিপিগুলো যেমন সহজ, তেমনই স্বাস্থ্যকর। যারা মাছ-মাংস খান না, তাদের জন্যও আছে নিরামিষ বিকল্প। আর যারা একটু নতুন চেয়ে থাকেন, তাদের জন্য পটোল-চালকুমড়ার খোসাও কম কিছু নয়।
গরম ভাত, একটু লেবুর রস আর এক চামচ ভর্তা—এই এক প্লেটেই লুকিয়ে থাকে হাজারো স্মৃতি আর অজস্র ভালোবাসা।
মন্তব্য করুন