কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৬ মে ২০২৫, ১০:৩৩ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন

বিদেশমুখী শ্রমিকদের পকেট কেটেছে টিকিট সিন্ডিকেট

বিমানবন্দরে বিদেশগামী বাংলাদেশি শ্রমিকরা। পুরোনো ছবি
বিমানবন্দরে বিদেশগামী বাংলাদেশি শ্রমিকরা। পুরোনো ছবি

বিদেশগামী বাংলাদেশি শ্রমিকদের পকেট কেটে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া টিকিট কেলেঙ্কারির প্রমাণ মিলেছে সরকারি তদন্তে। ১১টি আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্স, তাদের জেনারেল সেলস এজেন্ট (জিএসএ) এবং অন্তত ৩০টি ট্রাভেল এজেন্সি এই সিন্ডিকেটে জড়িত বলে তদন্তে উঠে এসেছে। আর এই সিন্ডিকেটের কেন্দ্রীয় ভূমিকায় রয়েছেন গ্যালাক্সি ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ ইউসুফ ওয়ালিদ। তাকে বলা হয়েছে টিকেট সিন্ডিকেটের মূলহোতা। ইতোমধ্যে কমপক্ষে এক ডজন ট্রাভেল এজেন্সিকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠিয়ে তলব করেছে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়।

বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের (এমওসিএটি) গঠিত ৯ সদস্যের তদন্ত কমিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘জিএসএ হিসেবে সৌদিয়া, কাতার এয়ারওয়েজ, সালাম এয়ার, জাজিরা এয়ারওয়েজ, ওমান এয়ার এবং থাই এয়ারওয়েজের টিকিটের একক নিয়ন্ত্রণ নেন ওয়ালিদ। তার প্রতিষ্ঠান যাত্রীদের নাম ছাড়াই গ্রুপ বুকিংয়ের মাধ্যমে টিকিট মওজুত করে, পরে সেগুলো অনানুষ্ঠানিকভাবে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে দ্বিগুণ বা তিনগুণ দামে বিক্রি করে। এতে করে ৫০ হাজার টিকেট এক থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়।

ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা নির্ধারিত ৭ শতাংশ কমিশনের বাইরে বাড়তি দাম নির্ধারণ করে টিকেট বাজার ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে ব্যাপক মুনাফা করেছে। এমনকি, কিছু প্রতিষ্ঠান সাব-এজেন্টদের মাধ্যমে ‘ব্লক টিকিট’ বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়ে চক্র গঠন করে টিকিট সিন্ডিকেট কারসাজি করে যাচ্ছে। এজেন্সিগুলোর মধ্যে রয়েছে- কাজী এয়ার ইন্টারন্যাশনাল, সিটিকম ইন্টারন্যাশনাল, কিং এয়ার এভিয়েশন, আরবিসি ইন্টারন্যাশনাল, মেগা ইন্টারন্যাশনাল, মাদার লাভ এয়ার ট্রাভেলস, জেএস ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস, সাদিয়া ট্রাভেলস, হাশেম এয়ার ইন্টারন্যাশনাল, নারিয়া ট্রাভেলস, এলহাম কর্পোরেশন এবং আল গাজী। ইতোমধ্যে সবাইকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়েছে।

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, আহমেদ ইউসুফ ওয়ালিদ ও তার স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব বড় অঙ্কের কর ফাঁকির অভিযোগে জব্দ করা হয়েছে। তাদের প্রতিষ্ঠান ইডিএস শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বিদেশি মদ বাজারজাত করছে বলেও তদন্তে উঠে এসেছে। ইতোমধ্যে করমুক্ত সুবিধার আড়ালে চালানো এই কর্মকাণ্ডে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর থেকে কয়েক দফায় অভিযান চালানো হয়েছে।

আটাবের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, ‘আহমেদ ইউসুফ ওয়ালিদের উত্থান মূলত ফ্যাসিস্ট সরকারের ছত্র ছায়ায়। তিনি ফ্যাসিবাদের দোসর ও তাদের বড় অর্থদাতা। গত ১৭ বছরে প্রায় ৮টি আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্সের জিএসএ এককভাবে নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে, পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান তার গোপন অংশীদার এই ওয়ালিদ। এসব ব্যবসার আয়ের একটি অংশ ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন নেতার পকেটে যায় বলেও তদন্তে উল্লেখ আছে।

এ বিষয়ে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও আহমেদ ইউসুফ ওয়ালিদের পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে কর কমিশনার মো. আব্দুর রকিব বলেন, ‘যারা কর ফাঁকি দিয়েছে এবং বাজার ব্যবস্থাকে ব্যবহার করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ৫০ হাজার টাকার টিকিট দেড় লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা নজিরবিহীন প্রতারণা ও শ্রমিকদের রক্ত শোষণ করা।

বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় বলছে, ‘টিকিট বিক্রির নামে কোনো সিন্ডিকেট বা শোষণ সহ্য করা হবে না। প্রবাসী শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ গত জানুয়ারিতে আটাবের (অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ) অভিযোগের পর ১১ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, যাত্রীর নাম ও পাসপোর্ট অনুলিপি ছাড়া কোনো অগ্রিম কোট টিকিট বুকিং করা যাবে না। এই নির্দেশনার ফলে অনেক মজুতকৃত টিকিট গ্লোবাল ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমে (জিডিএস) ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয় এয়ারলাইন্সগুলো। ফলে দাম কমে আসে এবং স্বচ্ছতা ফিরে আসে। বর্তমানে ঢাকা-জেদ্দা রুটে টিকিটের দাম ৪৮-৫০ হাজার টাকায় নেমে এসেছে, যা আগে ছিল প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার টাকা। টিকিটে খাত সিন্ডিকেট মুক্ত হওয়ায় শ্রমিক ও যাত্রীদের মধ্যেও স্বস্তি ফিরে এসেছে।

অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) মহাসচিব আফসিয়া জান্নাত সালেহ বলেন, ‘জিএসএ-দের কারণে প্রকৃত ট্রাভেল এজেন্সিগুলো টিকিট পেতো না। বরং তারা ঘুষের বিনিময়ে নির্দিষ্ট কিছু সিন্ডিকেটকে সুবিধা দেয়।’

সরকারের গঠিত উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, শুধু লাভের কথা না ভেবে জনসেবার দিকটিও বিবেচনায় রাখতে হবে। প্রবাসী শ্রমিকদের কথা মাথায় রেখে এয়ারলাইন্সগুলোকে দায়িত্বশীল হতে হবে। তবে এখনো কারসাজির মূল হোতাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতেও এমন সিন্ডিকেট গড়ে উঠবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত / খালেদা জিয়ার আগমনে গণতন্ত্রের পথ সুগম হবে

খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানাতে রাজপথে ছিলেন এ্যাবের প্রকৌশলীরা

বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সংক্রান্ত প্রথম সভা অনুষ্ঠিত

যুদ্ধকালীন সময়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে ভারতের সাধারণ মানুষ

মসজিদের এসি বন্ধ করে দিলেন ইউএনও

আবারও বাড়ল সোনার দাম, ২২ ক্যারেটের ভরি কত?

পুণ্ডরীক ধামে ফরহাদ মজহার, চিন্ময় দাসের মাকে দিলেন সান্ত্বনা

পাওনা টাকার জেরে ভ্যানচালককে হত্যা

চাঁদপুর শহরে মুক্তিযোদ্ধাকে মৃত দেখিয়ে ভাতা আত্মসাৎ করছেন স্ত্রী

নাটোরের প্রবীণ সাংবাদিক পিপলু মারা গেছেন

১০

রাবি অ্যালামনাই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মুখোমুখি বিএনপি-জামায়াত

১১

ঝিনাইদহে বজ্রপাতে প্রাণ গেল ২ কৃষকের

১২

বিশেষ অভিযানে মোহাম্মদপুর থেকে ২০ জনকে গ্রেপ্তার

১৩

উল্টো পথে চলাচলে ডিএমপির দেড় শতাধিক মামলা

১৪

সানা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভয়াবহ হামলা

১৫

অনুমতি ছাড়া চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী গ্রেপ্তার না করার সুপারিশ

১৬

সিলেটে আরও এক রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ

১৭

পাকিস্তানকে চোখ রাঙিয়ে ভারতের বিশাল সামরিক মহড়া

১৮

রাজধানীর নগর সংস্থাগুলোকে এক ছাতার নিচে আনার আহ্বান

১৯

মাদকাসক্ত তরুণের হাতে প্রাণ গেল ব্যবসায়ীর

২০
X